দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারলে তা দারিদ্র বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তা দিতে পারে স্বাস্থ্যবীমা। এমন মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের বিকন হাউস জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর শহীদ হাফিজ কারদার।
পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডন এ লেখা এক প্রবন্ধে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সরকারের ব্যয় বাড়ালে তা দারিদ্র বিমোচনে বেশি কার্যকর হবে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতে খরচ কমাতে সহায়ক হতে পারে স্বাস্থ্যবীমা।
তিনি বলেন, দারিদ্র বিমোচন এবং স্বাস্থ্য পরিচর্যার ফলাফল পারস্পারিকভাবে সম্পর্কিত। উন্নত স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা দারিদ্র বিমোচনে অবদান রাখে এবং বিপরীত ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবায় কাক্সিক্ষত উদ্যোগের অভাব দারিদ্র বিমোচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। গবেষণায় দেখা গেছে, স্বাস্থ্য পরিচর্যাখাতে ব্যয় দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচিতে ব্যয়ের চেয়ে বেশী কার্যকর। কারণ দারিদ্রতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে অসুস্থ্যতা বা মৃত্যুর কারণে আর্থিক ক্ষতি থেকে পরিবারগুলোকে রক্ষার অভাব। পরিবারের কোন সদস্যের বড় ধরণের অসুস্থতা পরিবারটিকে দারিদ্রের মধ্যে ফেলতে পারে। যদি তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম হন তাহলে পরিবারটি চরম দারিদ্রে পড়বে। দরিদ্র মানুষের সমস্যা হচ্ছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিকল্পনা থাকে না এবং চিকিৎসায় এককালীন বড় ব্যয়ের ধাক্কা সামলে ওঠতে পারে না। ওই প্রবন্ধে পাকিস্তানের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, পাকিস্তান গরীবদের জন্য স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এর কারণ দেশটিতে স্বাস্থ্য খাতে সরকার খুব কম ব্যয় করে। পাকিস্তান সরকার স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করে জিডিপির মাত্র ০.৫ শতাংশ । অথচ বেতন খাতে ব্যয় করা হয় জিডিপির ৭৫ শতাংশ। তবে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় এর চেয়ে ও কম করে নাইজেরিয়া ও সুদান। উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় জিডিপির ৫ থেকে ৭ শতাংশ। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের ব্যয় জিডিপির ২ শতাংশ। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তা ১ শতাংশ, নেপালে ২ শতাংশ ও চায়নাতে ৩ শতাংশ। স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয়ের এই চিত্রের ফলাফলটা হচ্ছে এমন- বাংলাদেশে ৫ বছরের নিচে শিশুমৃতুহার ৭৭ শতাংশ, ভারতে ৮৫ শতাংশ, শ্রীলংকায় তা ১৪ শতাংশ। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশই হয় বেসরকারিভাবে। বেসরকারিভাবে এ বিশাল অংকের ব্যয়টি হয় প্রতিরোধমূলক যতœ, পরামর্শ, রোগ নির্ণয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ঔষধের জন্য নগদ ব্যয়। উল্লেখ্য, ১৯৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটানে স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে সর্বোচ্চ । এ সময়ে দেশ তিনটিতে শিশু মৃত্যুহার কমে দাঁড়িয়েছে সর্বনিম্মে। এ সময়ে বার্ষিক গড় শিশু মৃত্যুও কমতির হার বাংলাদেশে ৭.৬, ভুটানে ৪.৭, নেপালে ৫.৮, শ্রীলংকায় ৩.৯, পাকিস্তানে ১.৯৬ এবং ভারতে ৩.১। এসব দেশে সরকারিভাবে স্বাস্থ্যখাতে এত কম ব্যয়েরও সমবন্টন নেই। তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর চেয়ে সমৃদ্ধশালীরাই এতে বেশি সুবিধা পায়। এর কারণ সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো ধ্বংসের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও রয়েছে অদক্ষতা ও দুর্নীতি। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান না থাকলেও তা যাচাই করার কোনো ব্যবস্থা নেই এবং এর জন্য কোনো জবাবদিহিতাও নেই। স্বাস্থ্যসেবার এই বৃহৎ বেসরকারিখাত নিয়ে ভারতের অবস্থা সম্পর্কে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য হচ্ছে ‘যা হাতুড়েগিরি এবং ঠকবাজির উপর বেড়ে উঠছে। যাকে সমতা, অধিকার এবং মানব মর্যাদার সম্মানের নীতিমালার ভিত্তিতে গ্রথিত করতে হবে।’ ভারতের এক গবেষণা দাবি করেছে, প্রতি বছর ৩৯ মিলিয়ন মানুষ চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে দরিদ্র হয়ে পড়ে। তারা দারিদ্রের দুষ্ট চক্রের মধ্যে পড়ে- দারিদ্র অসুস্থ্যতার জন্ম দেয় এবং অসুস্থতা দরিদ্র এবং ঋণগ্রস্থ করে। দারিদ্র নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় স্বাস্থ্যের ভূমিকার বিবেচনা করা উচিত। স্বাস্থ্যনিরাপত্তাকে শুধুমাত্র লক্ষ্য হিসাবে দেখা উচিত নয় বরং দারিদ্র বিমোচনের ব্যাপক উদ্দেশ্য অর্জনের কৌশল হিসেবে দেখা উচিত। স্বাস্থ্যপরিচর্যার কর্মকাণ্ডে অভাবে সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত হয় দরিদ্র মানুষ। ধনীদের চেয়ে এদের মৃত্যুহার এবং অপুষ্টিতে আক্রান্তের হার বেশী। বিশ্ব ব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি গবেষণা দেখিয়েছে, ভারতের জনগণের দরিদ্রতম অংশের ২৪% অসুস্থ হলে চিকিৎসা সেবা নিতে পারে না। দরিদ্র ভারতীয়দের বাৎসরিক ব্যয়ের ৫৮% এর বেশী ব্যয় হয় স্বাস্থ্য পরিচর্যায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য। হাসপাতালে চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে এদের ২৫% নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় মিটানোর জন্য এখন বিকল্প তহবিল ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন কারদার। তার মতে, স্বাস্থ্যবীমাই হতে পারে সেই বিকল্প কৌশল। এতে দরিদ্র জনগণ অল্পপরিমানে প্রিমিয়াম দিয়ে স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পেতে পারেন। প্রবন্ধে কারদার বলেন, ভারত গরীবদের জন্য সার্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা স্কিম চালু করেছে ২০০৩ সালে। এই স্কিমের আওতায় একটি পরিবারের ৫ জন পর্যন্ত সদস্য এক বৎসরের জন্য ৩০ হাজার রূপি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ পাবে। এছাড়াও পরিবারের প্রধান বা উপার্জনক্ষম সদস্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে প্রতিদিন ৫০ রুপি হিসাবে অসুস্থ্যতার ক্ষতিপূরণ এবং এক বৎসরের জন্য এক হাজার রুপি যাতায়াত খরচ পাবে। কারদার মনে করেন, স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজন অনুযায়ী তহবিল সংগ্রহ সহজ নয়। কারণ ভবিষ্যতের জন্য এবং অনিশ্চিত সুবিধার জন্য সঞ্চয় করা গরীবদের জন্য একটি বিলাসিতা। অন্যদিকে বৃদ্ধ এবং দরিদ্রতম ব্যক্তিরাও সঞ্চয় করতে পারে না। তাদের স্বাস্থ্য সেবা দিতে হয় সরকারিভাবে বিনামূল্যে। আর্থিক সামর্থের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে এটা খুব কঠিন কাজ। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবীমা তখনই কার্যকর হবে যখন খরচের একটি অংশ সুবিধাভোগিদের কাছ থেকে নেয়া যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রকাশিত-২০১৪-৫-২৫