ইসলামী জীবন বীমা: ৩ কোম্পানির পলিসি বিক্রি কমেছে ৫৪ শতাংশ
নিজস্ব প্রতিবেদক: সুদমুক্ত সঞ্চয়ের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ নতুন করে গ্রাহক পাচ্ছে না দেশে প্রথম অনুমোদন পাওয়া ৩টি ইসলামী জীবন বীমা কোম্পানি। বেসরকারি খাতের এসব কোম্পানির নতুন পলিসি বিক্রি কমে গেছে গড়ে অর্ধেকেরও বেশি। এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ২০১০ সালের পর থেকেই। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা এসব কোম্পানির তথ্য পর্যালোচনা করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
নতুন পলিসি বিক্রির হার কমে যাওয়া কোম্পানিগুলো হলো- প্রাইম ইসলামী লাইফ, ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ও পদ্মা ইসলামী লাইফ। ২০০০ সালে বীমা ব্যবসা করার অনুমোদন পায় এসব কোম্পানি। এরপরই সুদমুক্ত বীমা ব্যবসা পরিচালনা ও গ্রাহকের আর্থিক নিরাপত্তার নিশ্চিত করার শ্লোগান নিয়ে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালায়। ২০১০ সাল পর্যন্ত এর ফলাফলও পায় কোম্পানিগুলো। ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে গ্রাহক সংখ্যা ও প্রিমিয়াম আয়। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে এসব কোম্পানি বৃদ্ধিতে আকস্মিকভাবে ধস নামে।
বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিসি বিক্রি কমে যাওয়ার মূল কারণ গ্রাহকের পাওনা টাকা না দেয়া। অর্থাৎ মেয়াদ শেষে দাবি পরিশোধ না করা। গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার গ্রাহকের বীমা দাবির টাকা বকেয়া রেখেছে অনেক কোম্পানি। যার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে সব কোম্পানির ওপর। অন্যদিকে দাবির টাকা থেকে টাকা কেটে রেখে আবারও নতুন করে পলিসি করায় মাঠ পর্যায়ে এর বিরুপ প্রভাব রয়েছে।
তাদের মতে, নতুন কোম্পানির অনুমোদন, দক্ষ মাঠ কর্মীর অভাবের পাশাপাশি নতুন বীমা পণ্য না থাকা এর জন্য দায়ি। অন্যদিকে বীমা কোম্পানিগুলোর সীমাহীন দুর্নীতি ছাড়াও ইতিবাচক প্রচার প্রচারণার অভাব রয়েছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র মতে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৫ সালে এসে কোম্পানিগুলোর নতুন পলিসি বিক্রির হার কমেছে ৫৩.৯৮ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে পদ্মা ইসলামী লাইফের। কোম্পানিটির নতুন পলিসি বিক্রি কমে যাওয়ার পরিমাণ ৭৭.১৭ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে থাকা ফারইষ্ট ইসলামী লাইফের নতুন পলিসি বিক্রির হার কমেছে ৬০.৯৬ শতাংশ। আর প্রাইম ইসলামী লাইফের পলিসি বিক্রির হার নেমে এসেছে ২৩.৮৩ শতাংশে।
২০১০ সালে কোম্পানি ৩টির মোট ভ্যালুড পলিসি ছিল ২১ লাখ ৬ হাজার ৪১৯টি। যা ২০১৫ সালে এসে ১৯ লাখ ৭২ হাজার ৩৮৫টিতে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ৫ বছরে কোম্পানিগুলোর ভ্যালুড পলিসির সংখ্যা কমে গেছে ১ লাখ ৩৪ হাজার। এ হিসাব ধরা হয়েছে মেয়াদ উত্তীর্ণ, সারেন্ডার, মৃত্যদাবি ও ল্যাপসের সংখ্যা বাদ দিয়েই।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নতুন পলিসি বিক্রি সব চেয়ে বেশি কমেছে পদ্মা ইসলামী লাইফের। ৫ বছরে কোম্পানিটির নতুন পলিসি বিক্রি নেমে এসেছে ৭৭.১৭ শতাংশে। এই ৫ বছরের মধ্যে প্রথম ২ বছরে কোম্পানিটির পলিসি বিক্রি ভয়াবহ আকারে কমে যায় আর পরের ৩ বছরে কিছুটা বাড়ে। তবে তা ২০১০ সালের পলিসি বিক্রিকে ছুতে পারেনি।
সূত্র মতে, ২০১০ সালে পদ্মা ইসলামী লাইফ নতুন পলিসি বিক্রি করে ২ লাখ ৮ হাজার ২৯০টি। এর পরের বছরে ২০১১ সালে নতুন পলিসি বিক্রি ৫১.৪৩ শতাংশ কমে যায়। নতুন পলিসি বিক্রি হয় ১ লাখ ১ হাজার ১৫৪টি। পরের বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে কোম্পানি নতুন পলিসি বিক্রি আগের অবস্থা থেকে আরো ৬৭.০৮ শতাংশ কমে যায়। এ বছরে নতুন পলিসি বিক্রি হয় মাত্র ৩৩ হাজার ২৯৭টি।
তবে, ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩, ২০১৪ ও ২১০৫ সালে পলিসি বিক্রি কিছুটা বাড়ে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ২৪.১৮ শতাংশ বেড়ে নতুন পলিসি বিক্রি হয় ৪১ হাজার ৩৪৯টি। আর ২০১৪ সালে ২০১৩ সালের তুলনায় ৭১.৬১ শতাংশ বেড়ে নতুন পলিসি বিক্রি হয় ৭০ হাজার ৯৬০টি। এ বৃদ্ধি আবারো ২০১৫ সালে এসে কমে যায়। এ বছরে পলিসি বিক্রি হয় ৪৭ হাজার ৫৩৫টি। আগের বছরে তুলনায় এ বৃদ্ধি মাত্র ১৪.৯৬ শতাংশ।
পলিসি বিক্রি কমে যাওয়ার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ। গত ৫ বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির পলিসি বিক্রি কমে গেছে ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই পলিসি বিক্রি কমে যায়। এর মধ্যে ২০১১ সালে ৪.৯৮ শতাংশ, ২০১২ সালে ৪৪.২৩ শতাংশ, ২০১৩ সালে ২৮.৩৩ শতাংশ।
২০১১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত নতুন পলিসি বিক্রি করে ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪৮১ টি, ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪৯৭টি ও ১ লাখ ২৬ হাজার ৪৯৫টি। অথচ ২০১০ সালে পলিসি বিক্রি করেছিল ৪ লাখ ৩১ হাজার ৯০৫টি।
তবে পরের বছর থেকে পলিসি বিক্রি কমে যাওয়ার এ ধারা থেমে যায়। এ সময় পলিসি বিক্রি কিছুটা বাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের তুলনায় ২০১৪ সালে পলিসি বিক্রি ১০.১৯ শতাংশ বেড়ে নতুন পলিসি বিক্রি হয় হয় ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩৮৮টি। এর পরে বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে ২৩.০২ শতাংশ বেড়ে নতুন পলিসি বিক্রি হয় ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৭৭টি।
এদিকে নতুন পলিসি বিক্রির হার কমে যাওয়ার দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। ২০১০ সালের পর থেকে টানা তিন বছর কোম্পানিটির নতুন পলিসি বিক্রির হার ব্যাপকভাবে কমে যায়।মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির নতুন পলিসি বিক্রির পরিমাণ কমে যায় ২৩.৮৩ শতাংশ। তবে ২০১৪ সালে এসে এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতে শুরু করে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা কোম্পানিটির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১০ সালে প্রাইম ইসলামী লাইফের নতুন পলিসি বিক্রি হয় এক লাখ ১৫ হাজার ১৭ জন। তবে ২০১১ সালে এসে মাত্র ৯৪ হাজার ৯৬৩টি নতুন পলিসি বিক্রি হয়। সে হিসাবে ২০১১ সালে কোম্পানিটির পলিসি বিক্রি কমেছে ১৭.৪৩ শতাংশ।
২০১২ সালে এসে প্রাইম লাইফের নতুন পলিসি বিক্রিতে আরো ধস নামে। এবছর কোম্পানিটির পলিসি বিক্রি হয় মাত্র ৬৯ হাজার ৯৭১টি। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ২৪ হাজার ৯৯২টি বা ২৬.৩১ শতাংশ নতুন পলিসি বিক্রি কমে যায়। আর ২০১৩ সালে এসে কোম্পানিটির নতুন পলিসি বিক্রি কমে যায় ১৪ হাজার ৯০৩টি বা ২১.২৯ শতাংশ।
তবে ২০১৪ সালে এসে প্রাইম ইসলামী লাইফের নতুন পলিসি বিক্রির পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। এবছর কোম্পানিটির নতুন পলিসি বিক্রি হয় ৬১ হাজার ৮৩৮টি। যেখানে আগের বছরে নতুন পলিসি বিক্রি হয়েছিল মাত্র ৫৫ হাজার ৬৮টি। সে হিসাবে ২০১৪ সালে নতুন পলিসি বিক্রি বৃদ্ধি পায় ১২ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৫ সালে এসে কোম্পানিটির নতুন পলিসি বিক্রি হয় ৮৭ হাজার ৫৯৯টি। যা আগের বছরের তুলনায় ৪১.৬৫ শতাংশ।
এবিষয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হেমায়েত উল্লাহ বলেন, ২০১০ সালের পর থেকে রাজনৈতিক অস্তিরতার কারণে আমরা খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম। ফলে ব্যবসা ভালো করা যায়নি। তবে গত ২ বছর থেকে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। এ বছর আমরা ভালো করেছি। আশা করছি আগামী দিনগুলোতেও এ ধারা অব্যহত থাকবে।
পদ্মা ইসলামী লাইফের ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধরী ওয়াসিউদ্দিন বলেন, নতুন কোম্পানির অনুমোদন এ ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলেছে। আমাদের অনেক কর্মকর্তা চলে গেছেন। নতুন কোম্পানিগুলোতে তারা বড় পদে নিয়োগ নিয়েছেন। তবে সময়মতো দাবি পরিশোধ না করতে পারাকেও তিনি দায়ি করেন।