ইলিয়াসকে ঠেকাতে শেফাকের একি কাণ্ড!

নিজস্ব প্রতিবেদক: পদ্মা ইসলামী লাইফে ইলিয়াস হোসেনের মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগ ঠেকাতে অভিনব কাণ্ড ঘটালেন আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ। অনুমোদন না দেয়ার আর কোনো সুযোগ না থাকায় ন্যাক্কারজনক পথ বেছে নিলেন তিনি। ইলিয়াস হোসেনের অনুমোদনের আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করার অন্যতম কারণ দেখানো হয় সিআইবি রিপোর্ট দেরিতে পাওয়া। অথচ ওই পদেই নিয়োগের অনুমোদন দিলেন একজন ঋণখেলাপীকে । ঋণখেলাপী ওই ব্যক্তির অনুমোদন বাতিলও করলেন ২৬ দিনের মাথায়। আর আইডিআরএ’র এ কাণ্ডকারখানায় ক্ষতির মধ্যেই থেকে গেলে পদ্মা ইসলামী লাইফ। আর্থিক ঝুঁকির মধ্যেই থাকল কোম্পানিটির হাজার হাজার বীমা গ্রাহক ও শেয়ার হোল্ডার। এ ঘটনায় বীমা খাতে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে বীমা খাত নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হওয়ার পাশাপাশি স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বীমা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, এ কে এম ইলিয়াস হোসেনের সঙ্গে এম শেফাক আহমেদের দ্বন্দ দীর্ঘ দিনের। শেফাক আহমেদ আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই উঠে পড়ে লাগেন ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে। তার প্রথম বহি:প্রকাশ ঘটে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সে ইলিয়াস হোসেনকে নিয়োগ না দেয়ার মধ্য দিয়ে। গোল্ডেন লাইফে নিয়োগের আবেদনটি নাকোচ করা হয় ছাড়পত্র না নেয়ার অভিযোগে। ওই নাকোচপত্রে ইলিয়াস হোসেনকে কাণ্ডজ্ঞানহীন এমডি বলেও আখ্যা দেন শেফাক। এ ঘটনা ঘটে ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে। পদ্মা ইসলামী লাইফে মূখ্য নির্বাহী পদে নিয়োগের অনুমোদন চেয়ে ইলিয়াস হোসেন আবেদন করেন গত বছরের ৩০ এপ্রিল। ৮ মাসের বেশি সময় আটকে রাখার পর গত ২৬ জানুয়ারি প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ সংক্রান্ত আইডিআরএ’র অফিসার সামসুল আলম খান স্বাক্ষরিত চিঠিতে পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যানকে জানানো হয়, ‘ইলিয়াস হোসেনের নিয়োগ অনুমোদনের আবেদনের সাথে প্রবিধানমালার বিধান অনুযায়ী যোগ্যতা সম্পর্কীয় কাগজপত্রাদির ঘাটতি থাকায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্ট ও জীবন বীমা করপোরেশন হতে চাওয়া তথ্য বিলম্বে পাওয়ায় কর্তৃপক্ষ তার নিয়োগ অনুমোদনের আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে নাই। আবার নিয়োগ অনুমোদন কর্তৃপক্ষের বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় কোম্পানির প্রেরণকৃত পরিচালনা পর্ষদের তথ্যবিবরণী পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, কোম্পানির পক্ষ থেকে কোম্পানির ১৩৬তম পর্ষদ সভায় নূর মোহাম্মদ ভূঁইয়াকে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে একেএম ইলিয়াস হোসেনের নিয়োগ অনুমোদনের আর কোন কার্যকারিতা থাকে না। এমতাবস্থায় ইলিয়াস হোসেনের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের অনুমোদনের আবেদন প্রত্যাখান করা হলো। ’ তবে ইলিয়াস হোসেনের আবেদন প্রত্যাখান করার কারণ হিসেবে নুর মোহাম্মদ ভূঁইয়াকে নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও অদৃশ্য কারণে নিয়াগ দেয়া হয় কামরুল হাসানকে। আর তা দেয়া হয় কোনো রকম যাচাই-বাছাই না করেই। এ অনুমোদন দেয়া হয় আবেদন পাঠানোর মাত্র ১২ দিনের মধ্যে । কিন্তু কামরুল হাসান ঋণ খেলাপী হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় তা বাতিল করা হয় ২৬ দিনের মাথায়। সূত্র জানায়, দীর্ঘ সময় সিইও সংকটে থাকা পদ্মা ইসলামী লাইফের সিইও হিসেবে কামরুল হাসানকে অনুমোদন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় গত ১১ ফেব্রুয়ারি। এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি পদ্মা লাইফ কর্তৃপক্ষ কামরুল হাসানের নিয়োগ অনুমোদন চেয়ে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র কাছে আবেদন করে। ওই আবেদনে স্বাক্ষর করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. এ বি এম জাফর উল্লাহ। জানা গেছে, ঋণখেলাপী সংক্রান্ত সিআইবি রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত আইডিআরএ থেকে অন্যকোনো মূখ্য নির্বাহীকে নিয়োগ দেয়নি। এর আগে ইলিয়াস হোসেন অনুমতিপত্র না পাওয়ায় আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। এ নোটিশ করা হয় আবেদন করার ৭ মাস পর গত ১১ নভেম্বর। ওই নোটিশে ইলিয়াস হোসেন দাবি করেন, তিনি বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির পরিচালক, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ডিএমডি ও এএমডি, ন্যাশনাল ও বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এমডি পদে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। ওই সব শীর্ষ পদে থাকা কালীন অথবা এরপরেও তার বিরুদ্ধে কোনো অর্থিক অথবা অন্যকোনো অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। কিন্তু ৪ বছর পরে পদ্মা লাইফের সিইও হিসেবে ইলিয়াস হোসেনের নাম প্রস্তাবাকারে যাওয়ায় আইডিআরএ চেয়ারম্যান তার বিরুদ্ধে নাম-ঠিকানাবিহীন চিঠির ভিত্তিতে আর্থিক অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে যা ব্যক্তি ইলিয়াস হোসেনের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করছে। অপরদিকে পদ্মা লাইফেরও ব্যবসায়িক ক্ষতি সাধণ করা হচ্ছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই নোটিশের পর গত ২২ নভেম্বর বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে জানায়, একেএম ইলিয়াস হোসেনকে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ অনুমোদনের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নিকট প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এদিকে পদ্মা লাইফ ১০ ডিসেম্বরের এক সভার বরাত দিয়ে ইলিয়াস হোসেনকে জানায়, আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ তাকে সিইও নিয়োগে কোন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। এমনকি কোম্পানির পছন্দমতো অন্য কাউকে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগে বারবার চাপ প্রয়োগ করেছেন। অন্যথায় কোম্পানির বিরুদ্ধে নতুন করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ অবস্থায় ১৪ ডিসেম্বর জরুরি বোর্ড সভা পদ্মা লাইফ সর্বসম্মতিক্রমে দশ কার্যদিবস সময় নির্ধারণ করে। এই সময়ের মধ্যে আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে সদর্থক সিদ্ধান্ত না পাওয়া গেলে তার নিয়োগ প্রস্তাব বাতিলের কোন বিকল্প থাকবে না বলে ইলিয়াস হোসেনকে জানায় পদ্মা ইসলামী লাইফ। পরে গত ৪ জানুয়ারি সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন জানান একেএম ইলিয়স হোসেন। রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত ১০ দিনের সময় দিয়ে রুল ও নির্দেশনা জারি করে ইলিয়াস হোসেনের নিয়োগ আবেদন অনুমোদনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চায়। এই প্রেক্ষিতে ইলিয়াস হোসেনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দেয়া পত্রটি আদালতে দাখিল করে আইডিআরএ। বর্তমানে এই মামলা চলমান রয়েছে। জানা যায়, ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে গত ১৫ মে আইডিআরএ’র কাছে একটি অভিযোগ আসে। এতে বলা হয়, ইলিয়াস হোসেন জীবন বিমা করপোরেশন ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমিতে কর্মরত অবস্থায় বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম করেছেন। এ অভিযোগের পরেই ইলিয়াস হোসেনের সিইও নিয়োগ অনুমোদন আটকে দেয় আইডিআরএ। তবে এ বিষয়ে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। পদ্মা লাইফের সিইও সংক্রান্ত আইডিআরএ’র নথি সূত্রে জানা যায়, চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ দ্রুত তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এর আগে ওই নথিতে সদস্য মো. কুদ্দুস খান তার মতামতে লিখেছেন, ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, তার পরিচয় জানা যায়নি। এ অভিযোগ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত এমন উদ্দেশ্য প্রণোদিত অভিযোগের ভিত্তিতে কারও সিইও নিয়োগের অনুমোদন আটকে রাখা ঠিক হবে না বলেও অভিমত দেন আইডিআরএ’র এই সদস্য। এ বিষয়ে তিনি আরও উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি এই অভিযোগ দিয়েছে তদন্তের জন্য তাকে তলব করা যেতে পারে। তবে অভিযোগকারীকে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ কারেন মো. কুদ্দুস খান। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের আরেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাও তার অভিমতে পদ্মা লাইফের সিইও সংক্রান্ত আইডিআরএ’র নথিতে ইলিয়াস হোসেনের বিরুদ্ধে করা অভিযোগটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে উল্লেখ করেছেন। এর আগে সিইও নিয়োগ না দিয়ে দেড় বছর ধরে বিমা আইন ২০১০-এর ৮০(৪) ধারা লঙ্ঘন করে আসছিল পদ্মা ইসলামী লাইফ। আইনের এ ধারাটিতে বলা হয়েছে, বিমা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদ ৩ মাসের বেশি শূন্য রাখা যাবে না। তবে অপরিহার্য পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) এ সময় আরো ৩ মাস বাড়াতে পারবে। এ আইন লঙ্ঘন করায় ২০১৫ সালের এপ্রিলে কোম্পানির চেয়ারম্যানসহ প্রত্যেক পরিচালককে এক লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। এরপরও প্রায় ১০ মাস শূন্য ছিল পদ্মা ইসলামী লাইফের মূখ্য নির্বাহী পদটি। এর ফলে কোম্পানির শেয়ার গ্রাহক এবং পলিসি গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানায় বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। একই সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও সতর্ক করা হয়। ওই মাসেই সিইও হিসেবে একেএম ইলিয়াস হোসেনের নিয়োগ অনুমোদন চেয়ে আবেদন করে পদ্মা ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ।