ঠকবাজিতে পপুলার, রেহাই নেই হাসিনার

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতকানিয়ার লোহাগাড়ায় ছোট্ট এক ঝুপড়ি ঘরে থাকেন হাসিনা বেগম। বৃষ্টি হলেই ঘরের চাল ভেদ করে পানি পড়ে। দরিদ্র হাসিনার জীবন চিত্র দেখলেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের বিখ্যাত কবিতা ‘আসমানি’। ওই কবিতায় জসীমউদ্দীন আসমানিদের যে বর্ণনা তুলে ধরেছেন তার সঙ্গে হাসিনার জীবন যাপনের তেমন কোন পার্থক্য নেই। দারিদ্রতা নিরসনে আসমানিদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কোন বর্ণনা দেননি পল্লীকবি। সম্ভবত আসমানিদের সঙ্গে এখানেই বড় পার্থক্য সাতকানিয়ার হাসিনার। ভবিষ্যতে দারিদ্রতাকে জয় করার স্বপ্ন দেখেছিলেন ৫ সন্তানের জননী হাসিনা। সেই স্বপ্নের অংশ হিসেবেই পপুলার লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে ২০০৪ সালে একটি ক্ষুদ্র বীমা পলিসি কেনেন। ১২ হাজার টাকার এ পলিসির প্রতিমাসে কিস্তি ছিল ১০০ টাকা। হতদরিদ্র সংসারে খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে ৪ বছর ৭ মাস নিয়মিত কিস্তির টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু এরপরই হার মানেন হাসিনা। অভাবের কারণে কিস্তির টাকা জমা দিতে না পারায় বন্ধ হয়ে যায় তার বীমা পলিসি। এই হাসিনার সঙ্গেও ঠকবাজি করেছে পপুলার লাইফ। অভাবের কারণে একবার পলিসি তামাদি (বন্ধ) হয়ে যাওয়ায় হাসিনাকে আবারও নতুন করে বীমা পলিসি ধরিয়ে দিয়েছে এই জীবন বীমা কোম্পানি। অথচ এসবের কিছুই জানেন না হতদরিদ্র এই হাসিনা। নতুন করে চালু করা পলিসিটি চালানোর কোন সামর্থ্যও নেই তার। নতুন পলিসির (নং-০৭০৩৫০৮০০০৬১৭) প্রিমিয়াম জমা রশিদের (নং- ৪১৮১০৪৩৫) দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২৮ হাজার ৮০০ টাকার এ পলিসি ১২ বছর মেয়াদি। মাসিক কিস্তি ২০০ টাকা। নগদ প্রিমিয়াম জমা নেয়া হয়েছে ২০০ টাকা। অতিরিক্ত জমা নেয়া হয়েছে ২২০০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের প্রিমিয়াম এক সাথে নেয়া হয়েছে। প্রিমিয়াম জমার এ রশিদে বীমা গ্রাহকের ঘরে হাসিনার নাম লেখার জায়গায়, তা কেটে মরজিয়া বেগমের নাম লেখা হয়। হাসিনার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মরজিয়া বেগম তার চাচাত দেবরের বউ। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৪ সালে করা হাসিনার পলিসির (পলিসি নং-০৭০০১৬৪০০০০৫৫) মেয়াদ শেষ হয় ৩০ আগস্ট ২০১৪ সালে। বীমা দাবি বাবদ হাসিনাকে ৩ হাজার ৩শ’ ৮৯ টাকার চেক দেয়া হয় ৪ জানুয়ারি ২০১৫ সালে।( এক্সিম ব্যাংক চেক নং-১২৬১৪৬২-তারিখ-২৩-১২-২০১৪)। হাসিনা মোট প্রিমিয়াম জমা করেন ৫ হাজার ৫শ’ টাকা। এর সঙ্গে মুনাফা যোগ করা হয় ২৮৯ টাকা। এতে হাসিনার মোট পাওনা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৭৮৯ টাকা। এই পাওনা টাকা থেকে ২৪০০ টাকা কেটে বাকী টাকা তাকে দেয়া হয়। এই প্রতারণার সুবিচার চেয়ে গত ১৭ ফেব্রয়ারি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাবির টাকা থেকে অবৈধভাবে টাকা কেটে রেখে নতুন করে পলিসি করার বিষয়ে আবেদন করেছেন হাসিনা বেগম। একই সঙ্গে আবেদন করেছেন তাহেরা বেগম (পলিসি নং০৭০০১৬৪০০০০৭৩) ও বাদশা মিয়া (পলিসি নং০৭০০১৬৪০০০০৬৩) । তাদের কাছ থেকে ২৪০০ টাকা করে কেটে নিয়ে নতুন করে পলিসি করানো হয়। সবই করা হয় একই পদ্ধতিতে। বাদশা মিয়া নাম কেটে নতুন পলিসিতে (পলিসি নং-০৭০৩৫০৮০০০৬৩২) নাম দেয়া হয় মো. সোহেল, তাহেরা বেগমের নাম কেটে নতুন পলিসিতে নাম দেয়া হয় রোমেনা আক্তার (পলিসি নং-০৭০৩৫০৮০০০৬২৭) । অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, হতদরিদ্র বীমা গ্রাহকদের সঙ্গে অভিনব কায়দায় প্রতারণা করে যাচ্ছে পপুলার লাইফ। সারাদেশেই এমন অপকর্ম করছে কোম্পানিটি। মেয়াদ শেষে এসব বীমা গ্রাহক বীমা দাবির টাকা চাইতে গেলে প্রথমে তার কাছ থেকে পলিসির সকল কাগজপত্র জমা নিয়ে নেয়া হচ্ছে। পরে ওই কাগজপত্রের সঙ্গে দাবির আবেদন পত্র ও নতুন পলিসির প্রস্তাবপত্র পূরণ করে পাঠানো হচ্ছে প্রধান কার্যালয়ে। এসব কিছু তৈরি করা হচ্ছে ব্রাঞ্চ অফিসে বসেই। গ্রাহকের সঙ্গে আলোচনা না করেই। এমনকি নির্বাহী রশিদ গ্রাহককে না দিয়েই তা ব্রাঞ্চ থেকেই পাঠানো হচ্ছে প্রধান কার্যালয়ে। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাহী রশিদে গ্রাহকের স্বাক্ষর দেয়া হচ্ছে জাল করে। অভিনব এ প্রতারণা থেকে বাদ পরছে না কেউ।  যেসব গ্রাহক অর্থ সংকটে ৪/৫ বছর আগে পলিসির কিস্তি দেয়া বন্ধ করেছে, তাকেও বাধ্য করা হচ্ছে নতুন পলিসি করতে। কখনো এসব পলিসি দেখানো হচ্ছে ছেলে বা মেয়ের নামে, কখনো তা প্রতি বেশি কারো নামে। একই সঙ্গে এভাবে পলিসি করতে মাঠ কর্মীদেরও নানাভাবে অনৈতিক চাপ প্রয়োগ করছে কোম্পানিটি। পুরনো গ্রাহককে নতুন পলিসি করাতে জাল-জালিয়াতি করতেও বাধ্য করছে কোম্পানিটি। এ জন্য মাঠ কর্মীদের কমিশন, বেতন বন্ধ করে দেয়া, বহিস্কার করাসহ দেয়া হচ্ছে মামলার হুমকি। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ বীমা খাতের সবার মুখে মুখে। এদিকে চাপ সৃষ্টি করে মিথ্যা প্রলোভনে গ্রাহকদের পলিসি করতে বাধ্য করায় বিপাকে পড়ছে মাঠ কর্মীরা। অহরহই তারা গ্রাহকদের ক্ষোভ ও আক্রোশের শিকার হচ্ছে। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে তারা মুখ খুলছে না। মাঠ পর্যায়ের কোনো কর্মী মুখ খুললেই মিথ্যা মামলার শিকার হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ব্রাঞ্চ অফিস থেকে প্রধান কার্যালয়ে বীমা দাবির আবেদন পাঠাতে হলে বীমা দাবির সংশ্লিষ্ট কাজপত্রের সঙ্গে ওই গ্রাহকের নামে আরো একটি পলিসি করার আবেদন পত্র পাঠাতে বাধ্য করা হচ্ছে। কোম্পানিটি থেকে এই আবেদন পত্রের নাম দেয়া হয়েছে নতুন বীমা সমন্বয়ের আবেদন পত্র। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রের মধ্যে রয়েছে-মূল পাস বই, মূল সকল রশিদ, পিআর বিবরণী সাজানো ফরম, ভোটার আইডি/জন্ম নিবন্ধন সনদের সত্যায়িত ফটো কপি, ব্যাংকের জমা স্লিপ, নতুন বীমা সমন্বয়ের আবেদন পত্র, আইটি বিভাগ থেকে পলিসি স্টেটমেন্ট পরীক্ষিত। বীমা দাবির আবেদন পত্রের শেষে বি:দ্র: এ উল্লেখ করা হয়েছে অসম্পূর্ণ আবেদনপত্র গ্রহণযোগ্য হবে না। বীমা আইন অনুসারে গ্রাহক দাবির টাকা আদায়ে কোম্পানির কাছে আবেদন করলে তা পাওযার ৭ দিনের মধ্যে কোম্পানি তা যাচাই বাছাই করে গ্রাহকের কাছে চূড়ান্ত দাবিপত্র পাঠিয়ে দেয়। একে বলা হয় নির্বাহী রশিদ। গ্রাহক নির্বাহী রশিদে স্বাক্ষর করে দিলে কোম্পানি গ্রাহককে নির্বাহী রশিদে যে পরিমাণ টাকার উল্লেখ করা হয়েছে সে পরিমাণ টাকার চেক প্রদান করে। আইন অনুসারে গ্রাহকের কাছে কোনো টাকা পাওনা অর্থাৎ পলিসির বিপরীতে নেয়া ঋণের টাকা বকেয়া থাকলে তা দাবির টাকার সঙ্গে সমন্বয় করেই নির্বাহী রশিদে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করা হয়। নির্বাহী রশিদে যে পরিমাণ টাকা উল্লেখ করা হয় তাই গ্রাহককে চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। এ টাকা থেকে অন্যকোনো খাতে টাকা সমন্বয়ের কোনো সুযোগ নাই। বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড মূলত টাকা আত্মসাতের সামিল। তাদের মতে, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বীমা সম্পর্কে সচেতন নয়। ফলে এসব দরিদ্র গ্রাহক জানেন না কোম্পানি জোড় করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা কেটে রাখলে অথবা আবারও নতুন করে পলিসি করলে তার প্রতিকার কি? কোথায় তারা এর প্রতিকার পাবেন। অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও জীবিকার তাগিদে মুখ খুলতে চান না। আর এ সুযোগ কাজে লগিয়েছে পপুলার লাইফ। হাসিনা বেগম বলেন, ২০০৪ সালে যখন বীমা করি তখন আমাদের বলা হয়েছিল দ্বিগুন টাকা দেবে। ৪ বছর চালানোর পর টাকার অভাবে কিস্তি দিতে পারি নাই। কিস্তি দেয়া বন্ধ হলে আমরা এলাকার অফিসে গিয়ে টাকা চাই। তখন অফিস থেকে বলা হয় মেয়াদ শেষ না হলে টাকা দেয়া যাবে না। মেয়াদ শেষে পুরো টাকা দেয়া হবে। কিন্তু মেয়াদ শেষে আমার ২৪০০ টাকা কেটে রাখা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে হাসিনা বেগম বলেন, আমাদের কাছ থেকে সব কাগজপত্র জমা নিয়েছে। আমাদের কোনো কাগজপত্র দেয়নি। শুধু চেক দিয়েছে। নতুন করে পলিসি করার কোনো সামর্থ্য আমার নেই। আমরা গরীব মানুষ। যে টাকা কেটে রেখেছে সে টাকা পেলে আমার অনেক উপকার হয়। বাদশা মিয়া বলেন, জোর করে আমাদের হাতে নতুন পলিসি ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা আমাদের টাকা ফেরত চাই। বাদশা মিয়া, হাসিনা বেগমের মতো আরো অনেকে একই দাবি তোলেন এই প্রতিবেদকের কাছে। তারা সবাই ন্যায্য টাকা ফেরত চান। পপুলার লাইফের চট্টগ্রামের আল-আমিন বীমা প্রকল্পের সহকারি প্রকল্প পরিচালক লোকমান বলেন, গ্রাহকের সম্মতি নিয়েই পলিসি করানো হয়েছে। গ্রাহক সম্মতি দিয়েছে বলে নতুন পলিসির সঙ্গে বীমা দাবির টাকা সমন্বয় করা হয়েছে। বীমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রাহকের সম্মতি থাকলেও নির্বাহী রশিদ যে পরিমাণ টাকা কথা উল্লেখ করা আছে তাই গ্রাহককে দিতে হবে। গ্রাহক পলিসি করতে আগ্রহী হলে নতুন করেই গ্রাহক প্রিমিয়াম দিবে। টাকা কেটে রেখে পলিসি করার কোনো সুযোগ বীমা আইনে নেই। উল্লেখ্য, বীমা আইন ২০১০ এর ১৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বিভ্র্যান্তিকর, মিথ্যা বা প্রতারণামূলক বলিয়া জানেন, এইরূপ বিবরণী, আশ্বাস, পূর্বাভাস দ্বারা, বা প্রতারণামূলক বলিয়া জানেন, বা প্রতারণামূলক পূর্বাভাষ দ্বারা কোনো ব্যক্তিকে কোনো বীমাকারির সহিত বীমা চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করিলে তিনি এই অপরাধে অভিযুক্ত হইবেন এবং অভিযোগ প্রমাণিত হইলে অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থ দণ্ডে বা অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।” এ বিষয়ে কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিএম ইউসুফ আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাহী রশিদের সম্পূর্ণ অর্থই চেকের মাধ্যমে প্রদান করার নিয়ম রয়েছে। বীমা দাবির নিষ্পত্তির অর্থ সমন্বয় করার কোনো সুযোগ নেই। কোনো গ্রাহক নতুন করে আবেদন করলে তার কাছে পলিসি বিক্রি করা যাবে। পপুলারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নির্বাহী রশিদের অর্থ থেকে কর্তন করে নতুন পলিসি করার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মাহমুদা খাতুন নামের এক গ্রাহকের পলিসির নম্বর ইউসুফ আলীর মোবাইলে মেসেজ করে পাঠানো হলে চার দিনেও তার কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি।