এটিএম কার্ডের জালিয়াতি মোকাবেলায় কাজে আসছে না বীমা
আবদুর রহমান:
এটিএম কার্ডের লেনদেন ও সাইবার ঝুঁকি মোকাবেলায় বীমা সুবিধা নেয়ার সুযোগ থাকলেও তা নিচ্ছে না অধিকাংশ ব্যাংক। বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতি গতানুগতিক অনাস্থা ও সচেতনতামূলক পদেক্ষেপের অভাবকেই এমন অবস্থার জন্য দায়ি করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিনিয়তই বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। ফলে সুযোগ-সুবিধা বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে ঝুঁকি। প্রযুক্তিগত কাঠামোর দুর্বলতার সুযোগ ব্যবহারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে অপরাধী চক্র। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধের ঘটনা।
সম্প্রতি ইস্টার্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে ২১ জন গ্রাহকের একাউন্টে গচ্ছিত টাকা তুলে নেয়ার ঘটনায় তথ্যপ্রযুক্তি বা সাইবার ইন্স্যুরেন্সের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। এর আগে ২০১৩ সালে শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের সমন্বিত একটি চক্রকে গোয়েন্দারা ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল। ওই ঘটনার পর ব্যাংকগুলোকে বীমার আওতায় আনার কথা ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে “ব্যাংকার্স ব্যাংকেট বন্ড ইন্স্যুরেন্স” নামে বীমা পলিসির অনুমোদন দেয় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)।
বেসরকারি বীমা প্রতিষ্ঠান প্রাইম ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড প্রথম বারের মতো ওই বীমা পলিসি বাজারজাত করে। দেশের ৪৮টি ব্যাংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৪টি ব্যাংক বীমার আওতায় এসেছে। তবে আরো ৪/৫টি ব্যাংক এই পলিসি গ্রহণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, সিটি ব্যাংক লোকাল ও ইউনাইটেড কমার্সিয়াল ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে এই বীমা সুবিধা গ্রহণের আহবান করা হয়েছিল। কিন্তু সেটা তারা গ্রহণ করেনি বলে জানিয়েছেন প্রাইম ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদী খানম।
ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে তিনি আরো জানান, “ব্যাংকার্স ব্যাংকেট বন্ড ইন্স্যুরেন্স” পলিসির আওয়াতায় ক্যাশ ইন ট্রানজিট বা আন্ত: ব্যাংকিং লেনদেন ও এটিএম বুথগুলোতে টাকা সরবরাহের ঝুঁকি, কাউন্টার ট্রানজেকশন এবং ডিরেক্টর অ্যান্ড এম্পলয়েজ রিস্ক অর্থাৎ ব্যাংকিং কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক দায় থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সেবা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি অতিরিক্ত প্রিমিয়াম দিলে সাইবার রিস্ক অর্থাৎ সফটওয়ার ড্যামেজ ও হ্যাকড এর ঝুঁকি গ্রহণ করা হয়।
এদিকে মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নুরুল আমিন ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, "লাইফ এবং জেনারেল বীমা কোম্পানিগুলো আমাদের সেফটির জন্য যে প্রডাক্ট বাজারে নিয়ে এসেছে সেগুলো অবশ্যই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। এগুলো জনপ্রিয়তা পাচ্ছে না মূলত প্রচারণা ও সচেতনতার অভাবে। ব্যাংকগুলো অনেক ক্ষেত্রে খরচের কথা চিন্তা করেই এই নিরাপত্তমূলক প্রডাক্ট নিচ্ছে না।
তবে মোটা দাগে বলা যায়, সাইবার ক্রাইম নিরাপত্তায় ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হলেও বাংলাদেশে কোন ব্যাংক এ দিকে পা বাড়াচ্ছে না মূলত আস্থার সঙ্কট থেকেই। শতভাগ নিরাপত্তায় ইন্স্যুরেন্স পলিসি থাকলেও কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে দাবির অর্থ পাওয়া যাবে কিনা এ সন্দেহ আমাদের সবার মধ্যে। তাই দাবি না পাওয়ার অনিশ্চয়তা থাকায় আমরা এ ধরণের পলিসি করছি না"।
বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম কার্ডের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। এর পরের দশকের শুরু থেকে বাড়তে থাকে এর ব্যবহার। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকদের নামে ৯০ লাখের বেশি ব্যাংক কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৫ লাখ ডেবিট কার্ড এবং পাঁচ লাখ ক্রেডিট কার্ড। অন্যদিকে দেশজুড়ে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রায় সাত হাজার এটিএম বুথ রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রযুক্তি নির্ভর ব্যাংকিং সেবায় গ্রাহকের ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। এক্ষেত্রে অবকাঠামো, কার্ড ও তথ্যভাণ্ডার নিরাপত্তায় উপযুক্ত প্রযুক্তির অনুপস্থিতির পাশাপাশি রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত প্রযুক্তিজ্ঞানের অভাব। এমনকি এ বিষয়ে সচেতন নয় ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পরিষদও। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে জালিয়াতির ঘটনা এখনো কম। কিন্তু জালিয়াত চক্র এখন বেশি করে বাংলাদেশকে টার্গেট করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত তথ্য নিরাপত্তা জরিপে দেখা গেছে, দেশের ব্যাংকগুলোর ৩৪ শতাংশই অতি উচ্চমাত্রা ও ২৬ শতাংশ উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে। এটিএম ও অনলাইন ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে, এমন ব্যাংকের ৪০ শতাংশই ব্যবহার করছে নিম্নমানের প্রযুক্তি। দেশের ৪৭ শতাংশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত প্রযুক্তিজ্ঞানের অভাব রয়েছে। এ ধরনের ব্যাংকিং সেবা দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে ৭৬ শতাংশ ব্যাংকারের। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার দক্ষতার অভাব রয়েছে ৪৯ শতাংশ আর ২৪ শতাংশ ব্যাংককর্মী হালনাগাদ প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন নন।
এদিকে ইন্টারনেট ভিত্তিক ঝুঁকি বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও কার্যক্রম সম্পর্কিত ঝুঁকি থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যকে রক্ষা করতে বিশ্বব্যাপী দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে সাইবার ইন্স্যুরেন্স। তথ্যভাণ্ডারের সুরক্ষায় সাইবার ইন্স্যুরেন্স কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়টি অনুধাবন করতে শুরু করেছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। এ কারণেই তারা তথ্যের সুরক্ষায় সাইবার ইন্স্যুরেন্সের আশ্রয় নিচ্ছেন।
সাইবার ইন্স্যুরেন্স মূলত অপেক্ষাকৃত একটি নতুন পণ্য। যা ব্যবসা-বাণিজ্যকে ইন্টারনেট ভিত্তিক ঝুঁকি বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও কার্যক্রম সম্পর্কিত ঝুঁকি থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। এই প্রকৃতির ঝুঁকি সাধারণত প্রথাগত বাণিজ্যিক সাধারণ দায় পলিসি থেকে ভিন্ন। সাইবার ইন্স্যুরেন্স পলিসির আওতায় ক্ষতির বিপরীতে ফার্স্ট পার্টি কভারেজ যেমন তথ্য ধ্বংস, চাঁদাবাজি, চুরি, হ্যাকিং ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।
১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বে প্রথম সাইবার ইন্স্যুরেন্স বাজারে ছাড়া শুরু হয়। ২০১০ সালের দিকে বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে এবং ব্যাপকভাবে আলোচনায় উঠে আসে। তবে এসময় খুব অল্প কিছু কোম্পানি ছিল যারা সাইবার ইন্স্যুরেন্স পলিসি প্রস্তাব করতো। বর্তমানে অর্ধশতাধিক কোম্পানি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এবং ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের বীমা কাভারেজ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২০২০ সাল নাগাদ সাইবার ইন্স্যুরেন্সের বাজার তিন গুণ বেড়ে ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে।
বিশ্বব্যাপী পরিচালিত “পিডব্লিউসি গ্লোবাল স্টেট অব ইনফরমেশন সিকিউরিটি সার্ভে ২০১৬”শীর্ষক জরিপে বলা হয়েছে, বীমা খাতের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত অগ্রগতি লাভ করছে সাইবার ইন্স্যুরেন্স। আশা করা হচ্ছে, আগামী ২০২০ সাল নাগাদ সাইবার ইন্স্যুরেন্সের বর্তমান বাজার ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭.৫ বিলয়নে পৌঁছতে পারে।