নিজস্ব প্রতিবেদক:
ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে বিদেশি লাইফ বীমা কোম্পানি মেটলাইফ আলিকোর বাংলাদেশ শাখার। নতুন প্রিমিয়াম ও নবায়ন প্রিমিয়াম সংগ্রহসহ জীবন বীমা তহবিলের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে কোম্পানিটির।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৫২ সাল থেকে বাংলাদেশে ব্যবসা করে আসছে মেটলাইফ আলিকো। তবে বাংলাদেশে এর কোনো মালিকানা নেই। ফলে কোম্পানিটির গ্রাহকরা আস্থার সংকটে রয়েছে।
তাদের মতে, বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো সঠিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারছে না। আর এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েই আলিকো বাংলাদেশে ভালো ব্যবসা করে আসছে। কিন্তু আলিকোর মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কোম্পানিটি বাংলাদেশকে কোনো রকম মালিকানা না দিয়েই কোটি কোটি টাকার মুনাফা যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাচ্ছে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের স্বার্থের বিষয়টি বিবেচনা করে গত কয়েক বছর ধরে মুনাফার পুরো অংশ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এরপরও গ্রাহক স্বার্থ রক্ষা নিয়ে এক ধরণের অনাস্থা রয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম সংগ্রহে।
এছাড়া ভারতী কোম্পানি এলআইসি বাংলাদেশে ব্যবসা করতে আসায় মেটলাইফের ব্যবসা কমে যাচ্ছে বলেও মনে করছেন বীমা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মেটলাইফ আলিকোর বেশিরভাগ গ্রাহক শহুরে শিক্ষিত চাকরিজীবী শ্রেণী। এদের মধ্যে যারা এখনো পলিসি করেনি তারা নতুন কোম্পানির জন্য অপেক্ষা করছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের বীমা গ্রাহকরা একটা সময় মুনাফা সম্পর্কে সচেতন ছিল না। এখন পলিসি সেল করতে গ্রাহককে মুনাফার হিসাব দিতে হয়। গ্রাহক ভালো মুনাফা প্রত্যাশা করে। মেটলাইফ গ্রাহকদের সে চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তবে এ বিষয়ে কোম্পানিটির বাংলাদেশ শাখার রিজিওনাল সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নুরুল ইসলাম’র কাছে মতামত জানতে চাইলে তিনি কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
পরবর্তীতে একই কোম্পানির যোগাযোগ বিভাগের প্রধান মনরিুল ইসলাম ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’কে বলেন, বীমা মার্কেটে যদিও আমাদের শেয়ার ২৭ ভাগ তার পরেও নতুন অনেক কোম্পানি আসায় আমাদের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়েছে। এটি অবশ্য সুষম প্রতিযোগিতা।
এ কারণে গতবারের তুলনায় এবার আমাদের যে সামান্য প্রিমিয়াম আয় কমেছে। তবে সে বিষয়ে আমরা এখনো কারণ উদঘাটন করিনি। সার্বিক পর্যালোচনা শেষে বলতে পারবো কী কারণে এমনটি হয়েছে। তবে সামান্য ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। প্রয়োজনে সবক্ষেত্রে কোম্পানি আরো বেশি মনোযোগী হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মনরিুল ইসলাম।
২০১৫ সালে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা মেটলাইফ আলিকোর হিসাব অনুসারে ২০১৪ সালে তুলনায় ২০১৫ সালে নতুন প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমে গেছে ১৪.৩১ শতাংশ। আর মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ অর্থাৎ নতুন নবায়ন ও অন্যান্য খাতে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে ৪.৬২ শতাংশ। জীবন বীমা তহবিলে নতুন তহবিলের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে ৪.৯৯ শতাংশ।
সূত্র মতে, মেটলাইফ আলিকো প্রথম বর্ষ অর্থাৎ নতুন পলিসি বিক্রি থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করেছে ৩৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৪৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন পলিসি বিক্রি থেকে প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমে গেছে ৬২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ১৪.৩১ শতাংশ।
কোম্পানিটির প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমে গেলেও কমেনি কমিশন ব্যয়। ২০১৫ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহের জন্য কমিশন বাবদ ব্যয় হয়েছে ১১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আগের বছর অর্থা ২০১৪ সালের তুলনায় এ ব্যয় ৪.৮৩ শতাংশ বেশি। ২০১৪ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম সংগ্রহের জন্য কোম্পানি কমিশন দিয়েছে ১০৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
অন্যদিকে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে মাত্র ৪.৭১ শতাংশ। ২০১৫ সালে কোম্পানিটি নবায়ন প্রিমিয়াম আয় করেছে ১ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর ছিল ১ হাজার ৪৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ নবায়ন প্রিমিয়াম আয় বেড়েছে মাত্র ৭০ কোটি টাকা।
মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ০.৪০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৫ সালে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে ১৯২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা আগের বছর ছিল ১৯২১ কোটি। অর্থাৎ মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহ বেড়েছে মাত্র ৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ০.৪০ শতাংশ।
সূত্র মতে, প্রিমিয়াম সংগ্রহ কমে যাওয়ার পাশাপাশি কোম্পানিটির জীবন বীমা তহবিলে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। ২০১৫ সালের শুরুতে কোম্পানিটির জীবন বীমা তহবিল ছিল ৭ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। এ তহবিল ৮৫৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেড়ে ২০১৫ সাল শেষে দাড়ায় ৮ হাজার ৭৯১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আলোচ্য এক বছরে জীবন বীমা তহবিল বৃদ্ধি পায় ১০.৮০ শতাংশ।
তবে ২০১৪ সালের তুলনায় জীবন বীমা তহবিল বৃদ্ধির এ হার কমে যায় প্রায় ৪.৯৯ শতাংশ। ২০১৪ সালের শুরুতে জীবন বীমা তহবিলের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। বছর শেষে ১০৭১ কোটি টাকা বেড়ে মোট তহবিলের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বৃদ্ধি পায় ১৫.৬০ শতাংশ।
তবে কোম্পানিটির বিনিয়োগ কিছুটা বেড়েছে। ২০১৪ সালে বিনিয়োগ বেড়েছিল ১৩.৬৪ শতাংশ। সেখানে ২০১৫ সালে বিনিয়োগ বেড়েছে ১৫.০৯ শতাংশ। ২০১৪ সালে কোম্পানির মোট বিনিয়োগ ছিল ৭ হাজার ৭১১ কোটি টাকা, ২০১৫ সালে বিনিয়োগের এই পরিমাণ ১ হাজার ১৬৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বেড়ে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১৫.০৯ শতাংশ।
উল্লেখ্য, বিদেশি এই বীমা কোম্পানিটি বাংলাদেশে ১৯৫২ সাল থেকে ব্যবসা করছে। ২০১০ সালে সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলারে কোম্পানিটি কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ভিত্তিক জীবন বীমা কোম্পানি মেট্রোপলিটন লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি বা মেটলাইফ। তখন থেকে এর নতুন নামকরণ করা হয় মেটলাইফ আলিকো। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের শুরু থেকে বাংলাদেশে কোম্পানিটি নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করে মেটলাইফ।
আইডিআরএ সূত্র মতে, মেটলাইফ বাংলাদেশ থেকে ২০১৩ সালে ১১৪ কোটি ৭০ লাখ ৭১ হাজার টাকা মুনাফা কর। আর ২০১৪ সালে কোম্পানিটি মুনাফা করে ১০৪ কোটি ২ লাখ ৬২ হাজার টাকা। দুই বছরের মুনাফা ২১৮ কোটি ৭৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা থেকে প্রতিবছর ৯৩ কোটি ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার হিসেবে মোট ১৮৬ কোটি ৭৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা বাংলাদেশে রাখতে হবে বলে মেটলাইফকে জানিয়ে দিয়েছে আইডিআরএ। তবে মেটলাইফ বাকি প্রায় ৩৩ কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে পারবে।