স্বাস্থ্যবীমা ইস্যুতে মোড় নিতে পারে মার্কিন রাজনীতি!

আবদুর রহমান: আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশটিতে চলছে প্রার্থী নির্বাচন প্রক্রিয়া। চলতি বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র তার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। এ উপলক্ষে ২০১৫ সাল থেকেই প্রচার-প্রচারণা শুরু করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। দেশের উন্নয়ন ও নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে তুলে ধরছেন নতুন নতুন পরিকল্পনা। তবে সব পরিকল্পনাকে ছাপিয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি। যার মূলে রয়েছে ইন্স্যুরেন্স বা বীমা। মার্কিন নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে বীমার ব্যবহার নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা। বিতর্ক করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ধারণা করা হচ্ছে, এই স্বাস্থ্যবীমা ইস্যুতে মোড় নিতে পারে মার্কিন রাজনীতি। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে বারাক ওবামা তার নির্বাচনী ইশতেহারে স্বাস্থ্যসেবাকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে এনে দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন। স্বাস্থ্যসেবা নীতি ও পদ্ধতিতে বীমা শিল্পের ব্যবহারের চমক দেখিয়ে আমেরিকানদের মন জয় করেন ওবামা। ক্ষমতায় এসে চালু করেন প্যাশেন্ট প্রোটেকশন অ্যান্ড অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার এক্ট (পিপিএসিএ), বা সংক্ষেপে অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার এক্ট (এসিএ) । যা পরিচিতি লাভ করে ‘ওবামাকেয়ার’ নামে। স্বাস্থ্যসেবা শিল্প পুনর্গঠন করতে ২০১০ সালের ২৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বারা অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার এক্ট আইনে পরিণত হয়। আর ২০১২ সালের ২৮ জুন সুপ্রীমকোট এটিকে স্বীকৃতি দেয়। ওবামাকেয়ারের উদ্দেশ্য হলো- সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্মত স্বাস্থ্যবীমায় আমেরিকানদের আরো প্রবেশাধিকার দেয়া এবং দেশের স্বাস্থ্যসেবার ক্রমবর্ধমান খরচ কমানো। ভোক্তা সুরক্ষা, প্রবিধান, ভর্তুকি, কর, বীমা এক্সচেঞ্জ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্য বীমার ক্রয়ক্ষমতা, মান এবং প্রাপ্যতা সম্প্রসারিত করে এই কেয়ার এক্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার স্বাস্থ্যনীতি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও সমালোচনার ঝড় থেকে রেহাই পায়নি। চরমভাবে বিরোধীতার মুখে পড়েছে রিপাবলিকানদের। সমালোচনা করেছে অনেক বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানও। তাদের দাবি, ওবামার স্বাস্থ্যসেবা আইন আমেরিকানদের খরচ বাড়িয়েছে, চাকরিতে সমস্যা সৃষ্টি করেছে এবং বীমা পরিকল্পনা বা পছন্দের চিকিৎসক পেতেও অসুবিধায় ফেলেছে। তবে আগামী নির্বাচনেও মার্কিন নাগরিকদের স্বাস্থ্যবীমার সর্বোচ্চ সুবিধা দেয়ার ওপরই নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করছে বলে মনে করছেন অনেকে। আর এ কারণেই ওবামাকেয়ার’র বিরোধীতা করে নতুন স্বাস্থ্যনীতি প্রস্তাব করেছেন রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর কিছুটা সংশোধনের প্রস্তাবসহ ওবামাকেয়ার’রকে স্বাস্থ্যনীতি হিসেবে গ্রহণ করছেন ডেমোক্রেট দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ফার্স্টলেডি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি বলেছেন, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা পদ্ধতিতে কিছু ভুল রয়েছে, যেটা সমাধান করা প্রয়োজন। ক্রমবর্ধমান ওষুধের দাম কমিয়ে স্বাস্থ্যসেবা সবার নাগালে পৌঁছে দিতে বীমা শিল্পের সহযোগিতা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। প্রেসক্রিপশন ড্রাগ বা ব্যবস্থাপত্রের ওষুধের ক্রমবর্ধমান মূল্যের নাগাল টেনে ধরার প্রস্তাবও করেছেন ক্লিনটন। হিলারির ‘ওষুধের খরচ প্রস্তাবনা’য় বিধান করা আছে যেগুলোর উদ্দেশ্য ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো। মূল্য কমানোর জন্য তাদের সঙ্গে দরাদরি করতে মেডিকেয়ারের অনুমতিও রয়েছে ওই প্রস্তাবনায়। এছাড়াও একটি সুরক্ষার আহবান জানিয়েছেন হিলারি, যেটি বীমা কোম্পানিগুলোর দ্বারা প্রস্তাব করা হবে। এদিকে রিপাবলিকান দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আমি মানুষের সেবা করতে চাই। যদি তাদের অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তাদের সহযোগিতা করবো। কিন্তু এর দ্বারা ‘সিঙ্গেল পেয়ার’ বুঝায় না। এর অর্থ হলো আমরা জনগণকে সহযোগিতা করতে চাই। যদি কারো অর্থ না থাকে, রাস্তা মাঝে শুয়ে থাকে এবং মৃত্যুর পথযাত্রী হয়, আমি সেই ব্যক্তিকে সেবা করবো। আইওয়া ককাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একদিন আগে এবিসি’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব কথা বলেন। এই প্রকল্প কিভাবে চলবে এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, “আমরা হাসপাতালগুলোর সঙ্গে কাজ করবো। ডাক্তারদের সঙ্গেও কাজ করবো। আমাদের কিছু করার আছে”। রিপাবলিকান এই ধনকুবের ওবামাকেয়ার এর পরিবর্তে সম্পূর্ণ সরকার পরিচালিত একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালু করতে চান। তবে ট্রাম্পের স্বাস্থ্যসেবা কানাডার সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি ‘সিঙ্গেল পেয়ার’ এর মতো নয় বলে দাবি করেছেন তিনি। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেয়া ঘণ্টাব্যাপী এক সাক্ষাতকারে ডোনাল ট্রাম্প বলেন, “সবার ঝুঁকি গ্রহণ করা হবে। এটা বলা আমার জন্য একটা অ-রিপাবলিকান বিষয় কারণ তারা বারবার বলেছে, ‘না, না, ২৫ শতাংশের কম বেসরকারিভাবে পরিশোধ হতে পারে না’। কিন্তু আমি প্রত্যেকের সেবা করতে যাচ্ছি”। এটা কিভাবে হবে জানতে চাইলে ট্রাম্প  বলেন, “জনগণের সেবা করার জন্য আমি বিদ্যমান হাসপাতালগুলোর সঙ্গে চুক্তি করবো”। কে এই অর্থ পরিশোধ করবে- এমন প্রশ্নে ট্রাম্প বলেন, সরকার অর্থ দেবে। এর জন্য আমরা অন্য খাত থেকে অনেক অর্থ সংরক্ষণ করবো। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিডিয়াগুলোর প্রাথমিক ভবিষ্যদ্বাণী বলছে, শেষ পর্যন্ত ডেমোক্রেট দলের হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়বেন দেশটির সাবেক ফার্স্টলেডি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। আর রিপাবলিকানদের হয়ে লড়বেন আলোচিত-সমালোচিত ধনকুবের ক্যাসিনো ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে মার্কিন রাজনীতির বিধান হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি অঙ্গরাজ্য বা 'ককাসে' যে প্রার্থী জিতবেন- তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলের চূড়ান্ত মনোনীত প্রার্থী হবেন। ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন ও রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প উভয়ে নির্বাচনের প্রচারে নিজ নিজ দলের প্রতিনিধিদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন। তবে রিপাবলিকান নেতাদের বিশ্বাস, ট্রাম্প যদি শেষ পর্যন্ত দলের মনোনয়ন পান, তাহলে নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে রিপাবলিকানদের ভরাডুবি ঠেকানো অসম্ভব হবে। সবশেষ খবর অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী বাছাইয়ের প্রথম দফা ভোটাভুটিতে এক শতাংশেরও কম ব্যবধানে জয়ের দাবি করেছেন হিলারি ক্লিনটন। আইওয়া অঙ্গরাজ্যে ভোটাভুটির পর হিলারি ক্লিনটনের শিবির বলছে, তারাই এগিয়ে আছেন এবং তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বার্নি স্যান্ডার্স এখন আর কোনভাবেই হিলারি ক্লিনটনকে টপকাতে পারবেন না। অন্যদিকে রিপাবলিকান পার্টির ভোটাভুটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজ। বিজয়ের পর টেড ক্রুজ বলেছেন- এই ফলাফল প্রমাণ করে যে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কে হবেন তা মিডিয়ার ঠিক করার বিষয় নয়। ৪৪ বছর বয়সি টেড ক্রুজ ২০১২ সালে সিনেটর নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনের কঠোর সমালোচক তিনি। তবে নানা মতবিরোধ নিয়ে নিজ দল রিপাবলিকানের নেতাদের সঙ্গে তার দূরত্ব চোখে পড়ার মতো। আলোচিত-সমালোচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছেন। তবে আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি নিউ হ্যাম্পশায়ারে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে রিপাবলিকান ধনকুবের ট্রাম্প ভালো করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ক্রুজ ও ট্রাম্প উভয়েই রিপাবলিকান দলের নেতৃত্বের কাছে আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত। দলের সবচেয়ে রক্ষণশীল সমর্থকদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা থাকলেও জাতীয়ভাবে তারা ‘নির্বাচনযোগ্য’ নন।