বীমা প্রতিনিধির কাজের কৌশল

জীবনবীমা কোম্পানির প্রতিনিধি হিসাবে তারা হাটে-গ্রামে, শহরে-গঞ্জে, অফিসে-বাড়ীতে নিত্য নতুন জীবনবীমা ক্রেতাকে খুঁজে বেড়ান। তারা জনসাধারণকে জীবনবীমার উপকারিতা সম্বন্ধে অবহিত করে জীবনবীমা বিক্রয় করেন। জীবনবীমা বিক্রয় সহজ কাজ নয়। এজন্য জীবনবীমা প্রতিনিধিকে প্রথম হতেই সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে অগ্রসর হতে হয়। সেই কাজের কৌশল সম্পর্কে এখানে লিখছি। সম্ভাব্য ক্রেতার নাম সংগ্রহকরণ: জীবনবীমা প্রতিনিধির প্রথম কাজ হল জীবনবীমার সম্ভাব্য ক্রেতার নাম সংগ্রহ করা। ১৯ বৎসর হতে আরম্ভ করে সাধারণত ৫০/৫৫ বৎসর পর্যন্ত স্বাস্থ্যবান, উপার্জনশীল যে কোনো পুরুষ বা নারী জীবনবীমার সম্ভাব্য ক্রেতা হতে পারেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন পেশার সম্ভাব্য ক্রেতারা ছড়িয়ে আছেন। তাদের কেহ পরিচিত আবার কেহ বা অপরিচিত। তবুও তাদের নাম সংগ্রহ করতে তেমন অসুবিধা হয় না। বিভিন্ন অফিস-আদালত, সংবাদপত্র, গেজেট, বণিক সমিতি, ক্লাব ইত্যাদি স্থানে সম্ভাব্য ক্রেতার খোঁজ পাওয়া যায়। তা ছাড়া একটু তৎপর হলে এক নাম হতে আরেক নাম পাওয়া যায়। সম্ভাব্য ক্রেতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া: সম্ভাব্য ক্রেতার নাম সংগ্রহের পর তার সম্বন্ধে যথারীতি ওয়াকিবহাল হওয়া প্রয়োজন। তার মুখামুখি হওয়ার আগে তার স¤পর্কে সবকিছুই জানতে হবে। যেমন তার নাম, বয়স, পেশা, উপার্জন ক্ষমতা, ছেলেমেয়ের সংখ্যা ও অন্যান্য পারিবারিক বিষয়াদি। সম্ভব হলে তিনি কি প্রকৃতির লোক, তার মেজাজগত দিক, কোনো বিশেষ জিনিসের উপর তার আগ্রহ বা সখ আছে কিনা ইত্যাদি খবর সংগ্রহ করতে পারলে ভালো হয়। জীবন বীমাপত্র বিক্রয়ের জন্য এসব তথ্য সংগ্রহ করা অত্যাবশ্যক। কারণ ভাবী ক্রেতার কি প্রয়োজন, তিনি কি চান, কোনো বিষয়ে তিনি উৎসাহী এইগুলি যদি পূর্ব হতেই জানা না থাকে- তা হলে তাঁর শুভ দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হয় না। তাঁর ব্যক্তিগত প্রয়োজনের তাগিদ যদি সঠিকভাবে বুঝানো যায়, তা হলেই তিনি বীমাপত্র ক্রয় করতে আগ্রহী হবেন। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ না করে সম্ভাব্য ক্রেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে অনেক সময় ব্যর্থ হতে হয়। সব খবরাখবর নেওয়ার কোনো নির্দিষ্ট পথ নেই, নিজের জানাশুনা মহলের বিস্তৃতির উপর যতবেশী মানুষের সঙ্গে পরিচয় থাকে, ততবেশী তা জানা সহজ হয়।</p> উপরোক্ত সম্ভাব্য ক্রেতাদের পরিচিতি কার্ড সংরক্ষণ করতে পারলেও জীবনবীমা প্রতিনিধিদের সবচেয়ে সুবিধা হয়। প্রতিটি সম্ভাব্য ক্রেতার নামের প্রথম অক্ষর অনুসারে কার্ডগুলির ক্রমিক সংখ্যা দিতে হবে। পরিচয় কার্ড হতে সম্ভাব্য ক্রেতার আসল প্রয়োজন বের করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করে অগ্রসর হতে হয়। সম্ভাব্য ক্রেতার জীবনবীমার আসল প্রয়োজন নির্ণয় করা এবং তা বুঝানোর উপরই বিক্রয় সাফল্য নির্ভর করে। সে জন্য আমেরিকার বিখ্যাত বীমাবিদ Ben Feldman তাঁর গগনচুম্বী সাফল্যের অন্যতম কারণ হিসাবে বলেছেন,  “Don’t sell life insurance, but sell what life insurance can do. সম্ভাব্য ক্রেতাকে নিশ্চিত ক্রেতা করার জন্য সাক্ষাৎকার: সম্ভাব্য ক্রেতাদের স¤পর্কিত যাবতীয় তথ্যাদি সংগ্রহ সূচক কার্ড তৈরীর পর তাদের সাথে সাক্ষাৎকার শুরু করতে হবে। সাক্ষাৎকার সাধারণতঃ নিম্নরূপ হলে ভালো হয়: (ক) সকাল আটটা হতে দুপুর বারোটা (খ) অপরাহ্ন তিনটা হতে বিকাল পাঁচটা (গ) সন্ধ্যা ছয়টা হতে রাত সাড়ে আটটা দুপুর সাড়ে বারোটা হতে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত সচরাচর অফিসের কাজ থাকে। অবশ্য সাক্ষাৎকারের কোনো বাঁধাধরা সময় বলে দেয়া কোনো দিনই সম্ভব নয়। বিশেষ করে আমাদের সমাজের প্রচলিত অবস্থায় যেখানে অনেকেরই কাজ করা বা আহার নিদ্রার কোনো সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। তাই সম্ভাব্য ক্রেতার ইচছা অনুযায়ী কাজ করতে হয়। সাক্ষাৎকারও বিভিন্নভাবে হতে পারে, যেমন: (ক) সরাসরি সাক্ষাৎকার নির্ধারণ (খ) কার্ড পাঠিয়ে সাক্ষাৎকার নির্ধারণ (গ) টেলিফোনযোগে সাক্ষাৎকার নির্ধারণ (ঘ) পত্রের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নির্ধারণ সাক্ষাৎকার কোথায় কিভাবে ঘটবে তাও নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া যায় না। সম্ভাব্য ক্রেতার ইচছা বা মানসিকতার পরিপ্রেক্ষিতে তার বাড়ীতে কিংবা তার অফিসে সাক্ষাৎকার ঠিক করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে উক্ত সাক্ষাৎকারের স্থান, সময় ও পরিবেশ যেন হৃদ্যতাপূর্ণ ও আলোচনার অনুকূলে থাকে। সম্ভাব্য ক্রেতার কোনো রকম ব্যস্ততা না থাকলে তার মনকে সম্পূর্ণভাবে আলোচনার মধ্যে নিবিষ্ট রাখতে পারা যায়। অনেকেই অফিসে নানা কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকে, তাই এসব আলোচনা তারা বাড়ীতে করার পক্ষপাতী। অনেকে আবার বাড়ীতে ব্যবসা সংক্রান্ত আলাপ মোটেও পছন্দ করেন না। তাদের সঙ্গে অফিসেই আলোচনা করতে হয়। সাক্ষাৎকার যেখানেই ঘটুক না কেন একটা কথা সব সময় মনে রাখতে হবে যে অন্য লোকের উপস্থিতির সময় যতদূর সম্ভব আলোচনা বন্ধ রাখা। পরিশেষে লক্ষ্য রাখতে হবে যে ভবিষ্যৎ ক্রেতার কথাবার্তাতে গ্রহণযোগ্য একটা সহজাত মানসিক প্রবণতা এবং একটা নিভৃত পরিবেশ থাকা চাই। জীবনবীমা প্রতিনিধির বিক্রয় পর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল সাক্ষাৎকার। বিক্রয়ের পাঁচটি স্তর আছে, যেমন: ১. মনোযোগ আকর্ষণ: প্রথম সাক্ষাৎকারে সম্ভাব্য ক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। বীমা প্রতিনিধির এমন কথা বলা উচিৎ যাতে সম্ভাব্য ক্রেতা তার কথা শোনার জন্য প্রবল ভাবে আগ্রহী হন। প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি বীমাপত্র গ্রহণ না করলেও অন্ততঃ তার এই ধরণা যেন হয় যে, আগন্তুক একজন যথার্থ সম্মানিত ব্যক্তি এবং তার আগমন সত্য সত্যই কোনো না কোনো উপকারের জন্য। বীমা প্রতিনিধিগণ মার্জিত ও রুচিসম্পন্ন কথাবার্তা বলেন ও সর্বোপরি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এমন ধারণার জন্ম দিতে সাহায্য করে।         ২. প্রস্তাব উত্থাপন: এই স্তরে আলোচনা যথা সম্ভব দীর্ঘ না করে এমনভাবে বীমা পরিকল্পনার প্রস্তাব পেশ করতে হবে যা সম্ভাব্য ক্রেতার প্রয়োজনীয়তা আছে। ৩. আগ্রহ সৃষ্টি: সম্ভাব্য ক্রেতার বিশেষ চাহিদা মিটাতে পারে এ রকম এক বা একাধিক পরিকল্পনা তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে যা শুনে তার মনে সে পরিকল্পনা গ্রহণ করার একটা প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি হয়। ৪. বিক্রয় কাজ সম্পন্নকরণ: আলাপ আলোচনার সময় ভাবী ক্রেতার মনের উপর কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। উত্থাপিত বীমা প্রস্তাব তাঁর চাহিদা পূরণ করতে পারলে তিনি তা মনে মনে গ্রহণ করার জন্য আগ্রহী হবেন। এই মুহূর্তে বিভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগ করে বিক্রয় কাজ সমাপ্ত করতে হবে। ৫. বীমাপত্র প্রদান ও অধিকতর সেবায় আত্মনিয়োগ: বিক্রয় কাজ শেষ হতে যথাসময়ে বীমা গ্রহীতাকে বীমাপত্র প্রদান ও নিয়মিত দেখাশুনা ইত্যাদির মাধ্যমে বীমাগ্রহীতাকে সন্তুষ্ট রাখা বীমা প্রতিনিধির কর্তব্য। তাতে ভবিষ্যতে লাভবান হবার সম্ভাবনা থাকে। প্রথম সাক্ষাৎকারে ব্যর্থ হলে জীবনবীমা প্রতিনিধির হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সাক্ষাৎকারে তিনি সফল হতে পারেন। জীবনবীমার বিক্রয় কাজে সফলকাম হতে হলে ধৈর্যশীল, সংযমী ও খুব সাবধানী হতে হয়। অনেক সময় বীমা প্রতিনিধির যুক্তিতর্ক ও বিক্রয়শৈলীর নৈপুণ্য দ্বারা ভাবী ক্রেতাকে সম্পূর্ণভাবে বশ করতে পারা যায়। এভাবে প্রত্যেকটি জীবনবীমা কোম্পানি প্রতি বৎসর জীবনবীমা বিক্রয় করে যে কোটি কোটি টাকার প্রিমিয়াম অর্জন করে থাকে, তার সবটাই এই বীমা প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংগৃহীত হয়ে থাকে। এভাবে প্রিমিয়াম আকারে সংগৃহীত অর্থের অধিকাংশ দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হয়, ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়। সুতরাং দেশের বিভিন্ন জায়গা হতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় সংগ্রহ করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তা নিয়োজিত করার বেলায় বীমা প্রতিনিধিদের ভূমিকা অত্যন্ত কার্যকর। একইভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সঞ্চয় একত্রিত  করে জীবনবীমা প্রতিনিধিরা একদিকে যেমন দেশের পুঁজি গঠনে সহায়তা করে অন্যদিকে তেমনি অর্থের সঞ্চালন নিশ্চিত করে। মুদ্রাস্ফীতি রোধেও কার্যকর ভুমিকা পালন করে। জীবনবীমা কোম্পানির উন্নতি বা ব্যবসার প্রসারতা বীমা প্রতিনিধির উপর নির্ভর করে। তাই শিক্ষিত, দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বীমা প্রতিনিধি শুধু বীমা কোম্পানির পক্ষে নয়, একটি উন্নতিকামী দেশের পক্ষেও একান্ত প্রয়োজন। বীমা প্রতিনিধিগণ দেশের সর্বত্র জনসাধারণের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে বলে বিভিন্ন সময়ে বীমা কোম্পানিকে বিভিন্ন সমস্যাদির গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ প্রদান করতে পারে। বীমা প্রতিনিধিগণ প্রকৃতপক্ষে বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রকর্মী (field workers) । তাদের পরামর্শ ও মতামত বাস্তব ভিত্তিক। তাই বীমা কোম্পানি তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। বীমা প্রতিনিধিগণের কার্যাবলীর উপর বীমা কোম্পানির সুনাম ও অগ্রগতি নির্ভর করে বলে তাদেরকে অবশ্যই জনসাধারণের আস্থাভাজন ব্যক্তি হতে হবে এবং তাদেরকে অবশ্যই সৎ ও মহৎ গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। তাদের এই সততা ও গুণাবলীর উপরই তাদের ব্যবসার উন্নতি নির্ভর করে। জীবনবীমা প্রতিনিধি কোনো সময় অযোগ্য বা অপরাধমূলক কাজ করলে বা বীমাগ্রহীতা ও বীমা কোম্পানির স্বার্থ বিরোধী কোনো কাজ করলে, বীমা কো¤পানি বীমা প্রতিনিধির অনুমতি পত্র বাতিল করে দিতে পারে বা প্রয়োজনবোধে তার বিরুদ্ধে আইনী অভিযোগও আনতে পারে।