নিজস্ব প্রতিবেদক:
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’র (আইডিআরএ) নানামুখী পদক্ষেপে বিদায়ী বছর ২০১৫ সাল জুড়েই অস্থিরতার মধ্যে ছিল দেশের বীমা খাত। কোম্পানির ব্যবসার নিবন্ধন সনদ বাতিল, কোটি টাকার জরিমানা, পর্ষদ সদস্যদের জরিমানা, নিরীক্ষক নিয়োগের মতোও পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে বছর জুড়েই নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান ও সদস্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব, নিয়ন্ত্রক সংস্থা নতুন ভবনে স্থানান্তর, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে উপদেষ্টা নিয়োগ, আইডিআরএ’র জনবল নিয়োগ কাঠামো, আইনের প্রবিধান না হওয়া, সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোকে জরিমানার নতুন পদ্ধতি।
এর পাশাপাশি কোম্পানি দখল-পাল্টা দখল, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে চলতি দায়িত্বে (সিসি) নিয়োগও ছিল বীমা খাতের আলোচনার শীর্ষে। এর সঙ্গে বরাবরের মতো গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা, অবৈধভাবে অর্থ খরচ, চেক জালিয়াতি, ভুয়া এজেন্ট, অতিরিক্ত কমিশন, বাকি ব্যবসাসহ সকল ধরণের দুর্নীতি আর অনিয়ম অব্যাহত ছিল বছর জুড়েই।
মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএতে দক্ষ জনবলের অভাব ও উচ্চ পদে নিয়োগে অনিয়ম এবং আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণেই বছরজুড়ে বীমা খাতে অস্থিরত বিরাজ করেছে। অথচ নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইডিআরএ গঠনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বীমা খাতের দুর্নীতি দূর করে উন্নয়ন করা। এ জন্য দুর্নীতিপরায়ন সাবেক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা অধিদফতর বিলুপ্ত করে ২০১১ সালে আইডিআরএ গঠন করা হয়।
কিন্তু বীমা খাতের দুর্নীতি দূর করার বদলে উল্টো নতুন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিই নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে আগের নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্নীতিকেও ছাড়িয়ে গেছে আইডিআরএ। এ বিষয়গুলোও বছরজুড়ে বীমা কর্মকর্তাদের আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে।
কোম্পানির সনদ বাতিল
অনিয়মের কারণে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের নিবন্ধন সনদ বাতিল ছিল বিদায়ী বছরে বীমা খাতের সর্বোচ্চ আলোচিত বিষয়। পুনঃবীমায় অনিয়ম করার কারণে প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন সনদ বাতিল করে আইডিআরএ। দেশিয় সংবাদ মাধ্যমের পাশপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমেও এ ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্যমতে এটি ছিল গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বিমা খাতের ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে কখনো এশিয়া মহাদেশে অনিয়মের কারণে কোন বীমা কোম্পানির নিবন্ধন বাতিল হয়নি।
নতুন উপদেষ্টা
বিদায়ী বছরে প্রগ্রেসিভ লাইফের কর্মকর্তা এনায়েত আলী খান আইডিআরএ’র উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পাওয়া ছিল শীর্ষ আলোচনার বিষয়বস্তু। এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে। তিনি অনুমোদনহীন ভুয়া এজেন্টের মাধ্যমে প্রগ্রেসিভ লাইফ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা অত্মসাৎ করেন। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি মামলা চলমান রয়েছে।
গৃহদ্বন্দ্বে আইডিআরএ
আইডিআরএ গঠনের পর থেকেই প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। প্রথম ধাপে নিয়োগ দেয়া সদস্যদের বিদায় করে দেয়ার পরও চলতি বছরে সেই দ্বন্দ্ব অব্যহত আছে। এই দ্বন্দ্বের জের ধরেই অর্থমন্ত্রণালয়ে এক পক্ষ অপর পক্ষের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগও করেছেন।
নেই আইনের প্রবিধান
বীমা আইন পাশের পর একে একে ৫টি বছর পার হলেও তৈরি করা হয়নি আইনের অধিকাংশ বিধি ও প্রবিধানমালা। গত ৫ বছরে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ৯টি প্রবিধানমাল। আর এখনো আলোর মুখ দেখেনি ১৭টি বিধি ও প্রবিধানমাল। অথচ এই বিধি ও প্রবিধানমালা হলো আইনের ব্যাখ্যা। অর্থাৎ বিধি ও প্রবিধানমালা ছাড়া আইন মূলত অকার্যকর।
হয়নি লোকবল নিয়োগ
কয়েক দফা চিঠি চালাচালির মধ্য দিয়ে বিদায়ী বছরে আইডিআরএ’র জনবল নিয়োগের অনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়। গত ফেব্রুয়ারিতে এই অনুমোদনের পর ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও তার বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে ভাড়া করা (চুক্তি ভিত্তিক) লোকবল দিয়েই চলছে বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। আইডিআরএ গঠনের পর থেকেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটিতে এ অবস্থা বিরাজ করছে।
কোটি টাকা অবৈধ ব্যয়
সরকরি বীমা প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা করপোরেশনসহ ১৭টি জীবন বীমা কোম্পানি শেষ বছরে ৩০৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা অবৈধভাবে খরচ করেছে। কেম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় হিসেবে এ অবৈধ ব্যয় করা হয়।
ছয় কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ
আইন লঙ্ঘন করে গ্রাহকের টাকা খরচ করায় ২০১৫ সালে ৬টি জীবন বীমা কোম্পানিতে নিরীক্ষা করেছে আইডিআরএ। এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে সরকরি প্রতিষ্ঠান জীবন বীমা করপোরেশনসহ আছে পদ্মা ইসলামী লাইফ, ন্যাশনাল লাইফ, মেঘনা লাইফ, প্রগতী লাইফ ও সানফ্লাওয়ার লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
জরিমানার নতুন পদ্ধতি
অতিরিক্ত কমিশন দেয়া ও বাকি ব্যবসার জরিমানার ক্ষেত্রে বিদায়ী বছরে নতুন পদ্ধতি চালু করে আইডিআরএ। কোম্পানিগুলো যাতে জরিমানার বিরুদ্ধে রিট মামলা করতে না পারে সে উদ্যোগ নেয়া হয়। এর অংশ হিসেবে কয়েক মাসের অনিয়মের জন্য একবারে শুনানিতে ডাকা হয়। এরপর প্রতিটি অনিয়মের কারণে পৃথক পৃথকভবে জরিমানা করা হয়। আর প্রতিটি অনিয়মের জরিমানার জন্য কোম্পানিকে দেয়া হয় ৩টি করে চিঠি। এভাবে একবার শুনানি শেষেই একটি কোম্পানিকেই ২০টির উপরে চিঠি দেয়া হয়।
ফলে এ জরিমানার বিরুদ্ধে রিট মামলাও করতে পারেনি কোম্পানিগুলো। কারণ প্রতিটি চিঠির জন্য কোম্পানিগুলোকে আলাদা আলাদা রিট করতে হবে। এতেই যা খরচ তা প্রায় জরিমানার করা অর্থের সমান।
অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় ২০১৫ সালে আইডিআরএ সব থেকে বেশি জরিমানা করে প্রগতী ইন্স্যুরেন্সকে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে ৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া বছরটিতে ৩ লাখ থেকে ৪৭ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানিকে।
এরমধ্যে আছে- স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল, এশিয়া, রিপাবলিক, ইষ্টল্যান্ড, ইসলামী কমার্শিয়াল, ইউনাইটেড, রূপালী, সেন্ট্রাল, নিটল, ক্রিস্টাল, ফিনিক্স, পিপলস, গ্রীণ ডেল্টা, পাইওনিয়ার, অগ্রণী, গ্লোবাল, প্রাইম, কন্টিনেন্টাল, প্যারামাউন্ট, রিলায়েন্স, বাংলাদেশ জেনারেল, সিটি জেনারেল, মার্কেন্টাইল, তাকাফুল ইসলামী, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ ও জনতা ইন্স্যুরেন্স।
মাসের পর মাস ফাইল আটক
মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ অনুমোদনসহ বিভিন্ন ধরণের ফাইল মাসের পর মাস আটকে থাকে আইডিআরএ’র কার্যালয়ে। এমনকি ১৫ দিনের মধ্যে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়োগ অনুমোদনের আবেদনের সিদ্ধান্ত জানানো কথা থাকলেও কয়েক মাস আগে করা বেশ ক’টি আবেদন বর্তমানেও পড়ে আছে।
পরিচালনা পর্ষদের সব সদস্যকে জরিমানা
মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়মের কারণে পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদের সকল সদস্যকে ১ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। আইডিআরএতে প্রত্যেক পরিচালক ১ হাজার টাকা ফি দিয়েও আপিল করে এই জরিমানার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। প্রতিষ্ঠানটিতে উদ্যোক্তা পরিচালক, নিরপেক্ষ পরিচালক ও শেয়ার গ্রহীতা পরিচালক হিসেবে মোট ২০ জন পরিচালক রয়েছে। এরমধ্যে শেয়ার গ্রহীতা পরিচালক ৪ জন ও নিরপেক্ষ পরিচালক ৪ জন। তবে বীমা আইন অনুযায়ী একটি কোম্পানিতে ২ জনের বেশি নিরপেক্ষ পরিচালক থাকতে পারবে না।
নতুন কোম্পানি অনুমোদন
বিদায়ী বছরে দেশে প্রথমবারের মতো অনুমোদন দেয়া হয় দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানার জীবন বীমা কোম্পানি। এই কোম্পানিতে মূল উদ্যোক্তা হিসেবে আছে ভারতের বৃহত্তম জীবন বীমা কোম্পানি লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অব ইন্ডিয়া (এলআইসি)।
লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন (এলআইসি) অব বাংলাদেশ নামে অনুমোদন পাওয়া এই জীবন বীমা কোম্পানিতে বাংলাদেশ থেকে উদ্যোক্তা হিসেবে আছে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড (এমটিবিএল) ও ওয়েস্টিন গ্রুপের অ্যাসেট মেনেজমেন্টে কোম্পানি এসিএমএল।
এজেন্ট প্রশিক্ষণ
বিদায়ী বছরে প্রথমবারের মতো দেশে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে বীমা এজেন্টদের প্রশিক্ষণ। বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পেতে এখন থেকে প্রত্যেককে বাধ্যতামূলক ৭২ ঘণ্টার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এই প্রশিক্ষণ নিতে হবে আইডিআরএ থেকে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে।
নতুন ভবনে আইডিআরএ
পুরাতন ভবন ছেড়ে বিদায়ী বছরে সুসজ্জিত নতুন ভবনে উঠেছে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ। অবশ্য এ ভবনে স্থানান্তর হওয়ার আগেই অকারণে ১০ কোটি টাকা ব্যয় করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ।