অস্তিত্ব হারাচ্ছে বায়রা লাইফ, দিশেহারা গ্রাহকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমা কোম্পানিতে যত ধরনের অনিয়ম আছে তার সবই রয়েছে বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। এক কথায় ‘উপরে ফিট-ফাট ভেতরে সদরঘাট’ প্রবণতায় চলছে বেসরকারি জীবন বিমা কোম্পানি বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। বিভিন্ন সুবিধা দেখিয়ে নুতন নতুন পলিসি’র মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়েছে কোম্পানিটি। গ্রাহকদের কোনো দাবির টাকা দিচ্ছে না তারা। গ্রাহকরা তাদের পাওনা ফিরে পাবেন কি না তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সন্দেহ। এমনকি বিভিন্ন এলাকা থেকে শাখা অফিস গুটিয়ে নিচ্ছে কোম্পানিটি। অন্যদিকে কোম্পানির পরিচালকরাও মানছেন না উদ্যোক্তা-পরিচালকদের নূন্যতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণ এবং সম্মিলিত ৫০ শতাংশ শেয়ার ধারণ আইন। বছরের পর বছর খালি পড়ে আছে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) পদ। মোট কথা অনিয়মের র্শীষে বায়রা লাইফ। অনিয়মের কারণে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) জরিমানাও করেছে। এর ফলে বীমা গ্রহকরাও দাবি পূরণ নিয়ে রয়েছেন চরম শঙ্কায়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতিবছর আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির প্রিমিয়াম আয়। বছরে যে ব্যবসা করছে তার দুই গুণেরও বেশি ব্যয় হচ্ছে ব্যবস্থাপনা খাতেই। আর বছরে নতুন পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদি হচ্ছে অবিশ্বাস্য হারে। সর্বশেষ বছরে পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদির হার দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩০০ শতাংশের উপরে। অর্থাৎ ১০০টি পলিসি বিক্রি করলে তার বিপরীতে তামাদি হয়েছে ২ হাজার ৩০০টির বেশি। নতুন ও তামাদি পলিসি: চলতি বছরের প্রথম তিন মাসের পলিসি বৃদ্ধির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৩১টি কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে কম বৃদ্ধি পেয়েছে বায়রা লাইফের। উক্ত সময়ে মাত্র ১২৬টি নতুন পলিসি বৃদ্ধি পায় কোম্পানিটির। ২০১৪ সালে নতুন পলিসি বিক্রি হয় ১৪ হাজার ৫৯৬টি। এর বিপরীতে বছরটিতে পলিসি তামাদি হয় ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৭৭০টি। ২০১৩ সালে নতুন পলিসি বিক্রি হয় ১০ হাজার ২৪১টি। তামাদি হয় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮৬৬টি। ২০১২ সালে ১২ হাজার ৯০০টি পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদি হয় ৩ লাখ ১৭ হাজার ২৯৫টি। ২০১১ সালে ৪৮ হাজার ৬৮৬টি পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদি হয় ২ লাখ ৯৩ হাজার ২৯৮টি। আর ২০১০ সালে ৫৩ হাজার ৫৭৯টি পলিসি বিক্রির বিপরীতে তামাদি হয় ২ লাখ ৪১ হাজার ৩৯৬টি। কোম্পানিটির আয়-ব্যয়: সর্বশেষ ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রথম বর্ষে প্রিমিয়াম আয় করেছে মাত্র ৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে যা ছিল ৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০১২ সালে ৬ কোটি ২৭ লাখ, ২০১১ সালে ৫০ কোটি ৮৬ লাখ ও ২০১০ সালে ছিল ৮৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০১০ সালের পর থেকেই আশঙ্কাজনক হারে প্রিমিয়াম আয় কমেছে। ২০১৪ সালে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা খাতে খরচ হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। তবে আইন অনুযায়ী বছরটিতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা ছিল ৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আইনি সীমার চেয়ে বেশি খরচ করা হয়েছে ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে ব্যয় হয় ১৫ কোটি ১০ লাখ, ২০১২ সালে ১৫ কোটি ৮২ লাখ, ২০১১ সালে ৫৩ কোটি ৬৬ লাখ এবং ২০১০ সালে ব্যয় হয় ৮২ কোটি ২০ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির এমন চিত্র দেখে একাধিক জীবন বিমা কোম্পানির সিইও বলেছেন, বায়রা লাইফের আয়-ব্যয়, তামাদি পলিসিসহ ব্যবসার অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য চিত্র দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে ও গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে হবে। এদিকে আইডিআরএ’র একটি সূত্র জানিয়েছে, বায়রা লাইফের আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে ২০১১ সালে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস কোম্পানি এমজে আবেদিন অ্যান্ড কোম্পানিকে নিরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয় আইডিআরএ। তবে এরপর অদৃশ্য কারণে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আর কোন পদক্ষেপ নেয়নি আইডিআরএ। এ বিষয়ে আইডিআরএ একাধিক সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের পাওয়া যায়নি। নির্বাহী রশিদ প্রাপ্তির দেড় বছরেও টাকা পাচ্ছে না গ্রাহকরা: আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, বায়রা লাইফের শতাধিক গ্রাহক নির্বাহী রশিদ প্রাপ্তির দেড় বছরেও দাবির টাকা পায়নি। ৬/৭ মাস আগে ৪৪-০০৬৪৪ নম্বর পলিসি’র মেয়াদপূর্ণ হয় লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার বাসিন্ধা মো. রমজান আলীর। তিনি বলেন, ৬/৭ মাস আগে বীমার মেয়াদ পূর্ণ হয়। তখনই আবেদন করেছিলাম। নিয়মানুযায়ী জুন মাসে দাবির টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা পাইনি। স্থানীয় অফিসে যোগাযোগ করেও কোন লাভ হচ্ছে না। তারা বলেন, দাবির টাকা পেতে আইডিআরএ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে হবে। সে অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ আইডিআরএ-এর চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করা হয়। তিনি বলেন, আমরা গরিব মানুষ। ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে ভালো কিছু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বীমা কোম্পানিটি আমাদের আশা ভেঙ্গে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, ৩৬ হাজার টাকার বীমার বিপরীতে মাত্র চার হাজার টাকা লাভের হিসাব দিয়েছে কোম্পানি। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, লাভ যাই হোক আসল টাকা ফিরে পেলেই আমরা খুশি। তিনি তার সঞ্চয়ের টাকা ফিরে পেতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছেন। একই এলাকার বীমা গ্রাহক বরকত আলী (পলিসি নম্বর- ৪৪-০০০৮৬৯) জানান, পনের মাস আগে বীমার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর আবেদনের প্রেক্ষিতে নির্বাহী রশিদ পান। নির্বাহী রশিদ প্রাপ্তির পনের মাস পার হয়ে গেলেও তিনি তার দাবির টাকা বুঝে পাননি। তিনি বলেন, আমার মতো এরকম আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ চেক আটকে আছে। অথচ, অন্যান্য বীমা কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখা গেছে নির্বাহী রশিদ প্রাপ্তির এক মাসের মধ্যে দাবির টাকা পেয়ে যায়। কিন্তু আমাদের কোম্পানি বীমার টাকা দিতে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এরপর তারা গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর বিমা দাবির টাকা পেতে আবেদন করেন। ভুক্তভোগী গ্রাহকদের মধ্যে আরো রয়েছেন- ওয়াহাব আলী (পলিসি নম্বর ৪৪-০০০১১১), রেহানা বেগম (পলিসি নম্বর ১৯-০০০০৮৫), ত্রিণাথ চন্দ্র (পলিসি নম্বর ৩২৭-০০০০৩), গোলজার হোসেন (পলিসি নম্বর ৪৪-০০০৫২৩), হোসনে আরা (পলিসি নম্বর ১৭৯-০০০০৭২), জবেদা বেগম (পলিসি নম্বর ১৭৯-০০০০৮৫), নুর নাহার (পলিসি নম্বর ২৮৯-০০০০৪৬), জাহাঙ্গীর আলম (পলিসি নম্বর ৪৪-০০০১৮২), খোদেজা বেগম (পলিসি নম্বর ৪৪-০০০১৯৪), ফরমান আলী (পলিসি নম্বর ৪৪-০০০১৪৭), আশরাফুল (পলিসি নম্বর ৪৪-০০০০৩৯) প্রমুখ। পুঁজিবাজারে অন্তুর্ভুক্ত হতে ব্যর্থ: এদিকে দুর্বল আর্থিক অবস্থার কারণে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত হতে পারেনি কোম্পানিটি। ফলে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতিদিন জরিমানা গুণতে হচ্ছে এই জীবন বিমা কোম্পানিকে। বর্তমানে কোম্পানিটিকে প্রতিদিন ৫ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হচ্ছে। অর্থৎ বছরে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা গুণতে হচ্ছে বায়রা লাইফকে। অবৈধ ১০ পরিচালক: বীমা আইন-২০১০ ও বীমাকারীর নিবন্ধন প্রবিধানমালা-২০১৩ অনুযায়ী, বীমা কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালক পদে থাকতে হলে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের ন্যূনতম দুই শতাংশ শেয়ার থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোম্পানির ১২ উদ্যোক্তা-পরিচালকের মধ্যে ১০ জনেরই শেয়ার দুই শতাংশের নিচে। শুধু তাই নয়, এই ১০ উদ্যোক্তা-পরিচালকের মধ্যে আটজনের শেয়ার এক শতাংশের কম। তাদের মধ্যে আবার ছয়জনের ধারণ করা শেয়ার দশমিক ৫০ শতাংশেরও কম। উদ্যোক্তা-পরিচালকরা হলেন- ভাইস-চেয়ারম্যান এমএ সোবহান, পরিচালক সিরাজ মিয়া, রুশো চৌধুরী, মো. আশরাফ উদ্দিন, মীর মোহাম্মদ মারফত উল্লাহ, মো. অলি উল্লাহ, প্রকৌশলী জানে আলম, মিজানুর রহমান, ফজলে আকবর ও মো. ফরিদ আহমেদ। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. আবুল বাশার বলেন, গ্রাহকদের বিমা দাবি দ্রুত পরিশোধ করা হবে। আর যেসব এলাকায় অফিস নেই। সে এলাকার গ্রাহকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অফিসিয়ালি ব্যবস্থা নেয়া হবে। কোম্পানি থেকে গ্রাহকের টাকা ফিরে পেতে সমস্যা হবে না। কারণ গ্রাহকের টাকা কোম্পানিতে জমা আছে। তাছাড়া বিভিন্ন খাত থেকে আমরা যে মুনাফা পায় তা দিয়েই খরচ মেটাতে পারছি। আমাদের সামর্থ আছে বলেই যে ব্যবসা হয়েছে তার থেকে বেশি খরচ করতে পেরেছি। ফলে আমাদের কোম্পানিতে কোন সংকট নেই। আবুল বাশার বলেন, পরিচালকদের নূন্যতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের বিষয়টি তিনি কিছু জানেন না। এবিষয়ে কোম্পানির সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলে প্রদক্ষেপ নেয়া হবে বলে তিনি জানান। তবে প্রিমিয়াম আয়, ব্যবস্থাপনা ব্যয় ও তামাদি পলিসির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি। গত ১৫ বছর যাবত ব্যবসা করে আসলেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছি। তিনি বলেন, আমরা মুনাফায় আছি। কিন্তু অ্যাকচুয়ারি প্রতিবেদন তৈরি করতে না পারার কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারিনি।