অভাবের সংসারে সময়টা বেশ খারাপই যাচ্ছিল। ছোট্ট একটা গাড়িতে চার সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রীর যাতায়াত বেশ কষ্টকর। তাই প্রয়োজন একটা বড় গাড়ি কেনা। তবে সে সাধ্য আপাতত নেই। কিন্তু প্রয়োজন বলে কথা- গাড়ি তো কিনতেই হবে।
তাই চিন্তা করলেন নিজের গাড়ির বীমার টাকা আদায়ের। তবে চাইলেই তো আর বীমার টাকা পাওয়া যাবে না। উপযুক্ত কারণ থাকতে হবে। আর সেই কারণ সৃষ্টি করতেই মঞ্চস্থ করলেন একটি নাটক। সেটা ছিল গাড়ি দুর্ঘটনার নাটক।
পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট স্থানে ঘটানো হয় সেই দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার পর যথারীতি গাড়ি বীমার টাকা দাবি করা হয় সংশ্লিষ্ট কোম্পানীর কাছে। দাবি-দাওয়া পর্যন্ত সব ঠিকঠাক মতোই হচ্ছিল। তবে বাদ সাধে ঘটনাস্থলের পাশে স্থাপিত একটি সিসিটিভি।
দুর্ঘটনার কারণ তদন্তের সময় সেই সিসিটিভি’র ফুটেজে নাটকের সব কূট-কৌশল প্রকাশ হয়ে যায়। পরে যা হবার তাই- বীমা কেলেঙ্কোরীর অভিযোগে কোম্পানীর দাবি মোতাবেক আদালত তাদের দোষী সাব্যস্ত করেন।
ঘটনাটি ঘটেছে অস্ট্রেলিয়ায়। আট মাসের অন্তসত্বা এক নারী ও তার স্বামীর সহযোগী গাড়িচালক এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। ওই নারীর নাম ঘেনোয়া ফাদেল । আর অন্যজনের নাম জামাল জিরাই। তবে দুর্ঘটনায় ফাদেল ও তার পেটের সন্তানের কোন ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম।
সিডনি মর্নিং হেরাল্ড এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, চলতি বছরের মার্চ মাসে ব্যাংকসটাউন ইন্টারসেকশনে দুর্ঘটনার পর দেশটির পুলিশ ফাদেল ও দুর্ঘটনাকবলিত দু’টি গাড়ি উদ্ধার করে। পুলিশ জানায়, ফাদেল ৮ মাসের অন্তসত্বা। যিনি পাকস্থলী ও ব্যাক পেইন সমস্যায় ভুগছিলেন বলে জানিয়েছেন।
ফাদেল দুর্ঘটনার বর্ণনায় জানিয়েছেন, বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় স্টপ সাইনটি দেখতে না পাওয়ায় তার গাড়িটি অন্যপাশের রাস্তার গাড়ি চলাচলের যায়গায় থামিয়ে ছিলেন। কিন্তু সিসিটিভি’র ফুটেজে দেখা যায়, ফাদেল স্টপ সাইন দেখেছিলেন এবং কৌশল করেই সেখানে গাড়িটি থামিয়েছিলেন।
মূলত, বীমার দাবির পরিমাণ বাড়াতেই ২৫ বছর বয়সী ফাদেল ওই দুর্ঘটনা ঘটাতে সহযোগিতা করেন। স্টপ লইনে বা তার আগেই গাড়ি না থামানোর অভিযোগে এবং সুযোগ-সুবিধা পেতে মিথ্যা-বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়ায় ব্যাংকসটাউন আদালতে দোষি প্রমাণিত হন ফাদেল।
আদালতের জবানবন্দিতে অনুতপ্ত ফাদেল জানান, তিনি ‘একটি কঠিন সময়’ পার করছেন এবং ঘটনার বিষয়টি ‘সোজাভাবে চিন্তা করেননি’। তিনি বলেন, “আমি আমার গাড়িটি নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আমি আমার চার সন্তানের জন্য একটি বড় গাড়ি প্রয়োজন বোধ করছিলাম এবং এটার সামর্থ আমার ছিল না”। ফাদেল আরো বলেন, “আমি অবশ্যই খারাপ অনুভব করেছি… আর এ কারণেই আমি দোষী”।
ইন্সুরেন্স কাউন্সিল অব অস্ট্রেলিয়া (আইসিএ) জানিয়েছে, বীমার দাবি নিশ্চিত করতে এ ধরণের ঘটনা চর্চায় প্রফেসনাল ক্রিমিনালদের নেটওয়ার্ক খুবই সক্রিয় হচ্ছে। কারণ, এর ফলে কোম্পানীগুলোকে বীমার টাকা ও সুযোগ-সুবিধা কয়েক গুণ বেশি দিতে হয়। সম্প্রতি এসব ঘটনা বাড়ছে এবং গাড়ি বীমার প্রিমিয়ামের পরিমাণ প্রতিদিন লাখ লাখ ডলার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আইসিএ জানায়, ফাদেলের ঘটনার মতো ভুয়া দুর্ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই নিরব-নিস্তবদ্ধ এলাকায় ঘটানো হয় এবং সময় হিসেবে বেছে নেয়া হয় গভীর রাত। কারণ, এতে করে প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যাও কমে যায় এবং ঘটনা ফাঁস হওয়ার ঝুঁকিও অনেক কমে যায়।
ফাদেলের ঘটনাটি ঘটেছিল চলতি বছরের ১৭ মার্চ। সিসিটিভি’র ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনার সময় ঘড়ির কাটা ছিল ৩টার ঘরে। এমন সময় ফাদেল এবং তার দুষ্কর্মের সহযোগী জামাল তাদের নিজ নিজ গাড়ি নিয়ে ইন্টারসেকশনে উপস্থিত হয়।
ফাদেলের গাড়িটি সামনে এগিয়ে গেলেও জামাল গ্রই তার গাড়িটি দু’দফায় ইন্টারসেকশনে পজিশন মতো রেখে গাড়ি থেকে বের হয়ে যান। কয়েক মুহুর্ত পরেই ফাদেলকে দেখা যায় তার সাদা টয়োটা গাড়িটি নিয়ে একটু দূর থেকে সজোরে নিশান গাড়িতে ধাক্কা দিচ্ছেন।
একই সময় অন্য একটি গাড়িতে তৃতীয় একজন লোককে ঘটনাস্থলের চারদিকে প্রত্যক্ষ করতে দেখা যায়। সেই ব্যক্তি ছিলেন পুলিশ, তবে তার পরিচয় এখনো জানা যায়নি। দুর্ঘটনায় ক্ষতি পরিদর্শন করে তিনি ফাদেলের গাড়িতে চড়ে দ্বিতীয়বারের মতো সংঘর্ষ লাগান। এরপর খুব দ্রুত পুলিশ কর্মকর্তা ও এম্বুলেন্স উপস্থিত হয়।
এঘটনার পর ওই দিন ফাদেল এবং জামাল গ্রই তাদের বীমা কোম্পানীর কাছে পৃথক বীমা দাবি করেন। একত্রে তাদের বীমার মূল্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০,০০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার। যখন একটা কোম্পানী ফরেনসিক রিপোর্ট তৈরি করে তখন এতে দু’টি পৃথক সংঘর্ষ দেখা যায়। দুর্ঘটনার সময় জামালের গাড়ি স্থির থাকলেও তা প্রকাশ করা হয়নি।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের সময় সিসিটিভি’র ফুটেজ দেখানোর আগ পর্যন্ত ফাদেল এবং জামাল তাদের আসল গল্পই অনুসরণ করেন। ফাদেল জানান, সংঘর্ষের সময় তিনি আঘাত কমাতে পেটে বালিশ ব্যবহার করেছিলেন।“এটা ছিল বোকার কাজ”, “আমারা আমাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছি” জানান ফাদেল।