নন লাইফ বীমায় কমিশনের নামে হাজার কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের নন লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোতে কমিশন খাতে অবৈধভাবে বছরে হাজার কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। এ অবৈধ লেনদেনের এজেন্টদের আয় হচ্ছে অবিশ্বাস্য পরিমাণ। ক্ষেত্র বিশেষে একজন এজেন্টের আয় সাড়ে ৬ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে । অথচ ননলাইফ বীমা কোম্পানিতে কর্মরত উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিজেরাই বলছেন ননলাইফ বীমা খাতে কোনো এজেন্ট নেই । প্রিমিয়াম সংগ্রহ করছেন বীমা কোম্পানিতে কমর্রত নির্বাহীরা । বীমা সংশ্লিষ্টরা জানান, বাস্তবে কোম্পানিগুলোতে কোনো এজেন্ট নেই । প্রিমিয়াম সংগ্রহ করছে কোম্পানিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। কোম্পানিতে যেসব এজেন্ট দেখানো হচ্ছে তার সবই ভুতুড়ে।কোনো এজেন্টই কমিশনের টাকা পায় না। কমিশন যায় মূলত, ব্যাংক ম্যানেজার, বীমা গ্রাহক ও একশ্রেনীর অসাধু ব্যক্তির পকেটে । বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে ননলাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর দাখিল করা তাদের পরিসংখ্যান অনুসারে ননলাইফ বীমা খাতে এজেন্ট রয়েছে ৩ হাজার । এই এজেন্টদের মাধ্যমেই বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ওপরে প্রিমিয়াম সংগ্রহ দেখাচ্ছে কোম্পানিগুলো । দেশে বেসরকারি ননলাইফ কোম্পানি রয়েছে ৪৬টি । আর্থিক প্রতিবেদনে কোম্পানিগুলো এজেন্টদের আয় দেখিয়েছে লাখ লাখ টাকা।এর মধ্যে গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের প্রত্যেক এজেন্ট গড়ে প্রতিমাসে আয় ৫ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৮ টাকা, শিকদার ইন্স্যুরেন্সে সাড়ে ৬ লাখ টাকা, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্সের ২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, নিটল ইন্স্যুরেন্সের ২ লাখ ৬৫ হাজার ২১৭ টাকা, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের আয় ১ লাখ ৭৯ হাজারা টাকা । একই অবস্থা বাকি সব ননলাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর । বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বীমা আইনে ১৫% কমিশন দেয়ার বিধান রয়েছে । কিন্তু কোম্পানিগুলো তা মানে না। কোম্পানিগুলো ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিচ্ছে। এ হিসেবে দেশের বেসরকারি ননলাইফ বীমা কোম্পানিগুলো গত ৩ বছরে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা কমিশন দিয়েছে।যার পুরোটাই লেনদেন হয়েছে অবৈধভাবে । বীমা সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৫% কমিশনের লেনদেন এজেন্টদের ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে হলে অতিরিক্ত কমিশনটি দেয়া হয় বেনামী একাউন্টের মাধ্যমে। প্রত্যেকটি ব্রাঞ্চে থাকে একাধিক একাউন্ট। এসব একাউন্টের সিগনেটরি থাকে ও ব্রাঞ্চেরই কোনো না কোনো কর্মকর্তা। তাদের মাধ্যমে অতিরিক্ত কমিশনের রফাদফা হয়। পরিসংখ্যান অনুসারে ননলাইফ বীমা কোম্পানিগুলো ২০১৪ সালে ৩০০৭ জন এজেন্টকে কমিশন দিয়েছে ৪৬০ কোটি ১০ লাখ টাকা।এর আগের বছর ২০১৩ সালে ৩২৬৯ জন এজেন্টকে কমিশন দিয়েছে ৫২২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা । একই চিত্র ২০১২ সালে। এ বছরে ৩৩৫১জন এজেন্টকে কমিশন দিয়েছে ৫৩২ কোটি ১০ লাখ টাকা । বীমা সংশ্লিষ্টরা জানান, কোম্পানিগুলো বিভিন্ন নামে এজেন্ট লাইসেন্স নেন । এসব লাইসেন্সের বেশিরভাগই নেয়া হয় কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিচালকদের পরিবারের সদস্য, স্ত্রী ছেলে মেয়েদের নামে । পরে ডামি এসব এজেন্টদের নামে খোলা একাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করা হয় কমিশনের টাকা । এজেন্টদের এসব একাউন্ট পরিচালনাও করে কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা । এজেন্টদের একাউন্ট থেকে টাকা তুলে তা দেয়া হয় গ্রাহক ও ব্যাংক ম্যানেজারদের । বীমা আইন ২০১০ এর ৫৮ ধরার ১ উপধারায় এজেন্ট ছাড়া অন্য কারো মাধ্যমে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া এজেন্ট ছাড়া অন্য কাউকে প্রিমিয়াম সংগ্রহের জন্য কমিশন বা পারিশ্রমিক দেয়াও নিষেধ । কিন্তু এই আইন কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন হলেও প্রকৃত পক্ষে এর কোনো বাস্তবতা নেই । ভূতুড়ে এজেন্টদের একাউন্টের মাধ্যমেই কোম্পানিগুলো কোটি কোটি টাকার লেনদেন করছে । পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশের বৃহৎ ননলাইফ বীমা কোম্পানি গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের ৫৩ জন এজেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে ৩৪ জনই নারী। গত বছরে তাদের আয় ৩৬ কোটি কোটি ৭৪ লাখ টাকা । অর্থাৎ মাসে তারা প্রত্যেকে আয় করেছে ৫ লাখ ৭৭ হাজার টাকা । আর গত এক বছরের প্রত্যেক এজেন্ট আয় করেছে ৬৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা । এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের এজেন্ট রয়েছে ২৮ জন। এই ২৮ জন এজেন্টের মধ্যে ২৬ জনই নারী। তাদের মাসিক আয় ১ লাখ ৭৮ হাজার টাকা । কোম্পানিটি ২০১৪ সালে মোট প্রিমিয়াম আয় করে ৪৩ কোটি ৭৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা । এর বিপরীতে কমিশন দেয় ৬ কোটি ১ লাখ টাকা। গত তিন বছরে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম সংগ্রহ বাড়লেও এজেন্ট সংখ্যা বাড়েনি। ২০১২ সালে কোম্পানিতে এজেন্ট ছিল ৭৯ জন, ২০১৩ সালে তা কমে আসে ২৭ জনে, ২০১৪ সালে এজেন্ট একজন বেড়ে ২৮ জন হয়। অন্যান্য কোম্পানিগুলোর অবস্থাও একই রকম । এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের ২৬জন নারী এজেন্টের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলে কোম্পানিটির মূখ্য নির্বাহী কে. এম সাইদুর রহমান বলেন, কোম্পানিতে কোনো এজেন্ট নেই, এটা সবাই জানে। এ বিষয়ে আমি আইডিআরএর চেয়ারম্যান মহোদয়কে এজেন্ট প্রথা তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, বীমা আইনে এর কোনো সুযোগ নেই। সাইদুর রহমান আরো বলেন, আমরা এজেন্ট ছাড়াই যদি প্রিমিয়াম সংগ্রহ করি তাহলে কমিশন দিতে হবে কেন? ২৬ জন নারী এজেন্টের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার নারী এজেন্টদের নিয়ে কোনো প্রতিবেদন ছাপানো হলে আমি মামলা করবো । এ প্রসংগে গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী ফারজানা চেৌধুরীর সংগে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানিতে এজেন্ট সংখ্যা কম এটা ঠিক। তবে আমরা এজেন্ট সংখ্যা বাড়ানো চেষ্টা করছি ।