প্রিমিয়াম বাবদ গ্রাহকের জমা করা টাকা আত্মসাৎ করতে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় প্রদর্শন করছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ভূয়া প্রিমিয়াম সংগ্রহ দেখিয়ে উচ্চহারে কমিশন, অবৈধ ব্যবস্থাপনা ব্যয়, গাড়ি, অফিস ভাড়াসহ নানা খাতে ব্যয় দেখিয়ে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এতে প্রতিবছরই দাবি পরিশোধের সক্ষমতা হারাচ্ছে কোম্পানিটি। ফলে বীমা দাবি পাওয়া নিয়ে চরম অনিশ্চতায় পড়েছে কোম্পানিটির গ্রাহক।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বীমা দাবির টাকা না পাওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় পদ্মা ইসলামী লাইফের গ্রাহকদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অনেক এলাকায় কোম্পানিটির কর্মকর্তারা এলাকা ছেড়ে দিয়েছে। গ্রাহকদের রোষাণলে পড়ার ভয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শাখা অফিসগুলোও গুটিয়ে নিচ্ছে তারা।
এমন অবস্থাতেও কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের বীমা দাবি ঠিকভাবে নিষ্পত্তি না করে উল্টো নিজেদের স্বার্থে ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়িয়ে যাচ্ছে। কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনো আইন মানছে না। বছরের পর বছর ধরে চলছে এমন অবস্থা। কোম্পানিটি ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ১৩৭.৮২ কোটি টাকা অবৈধভাবে ব্যয় করে। এই টাকার ৯০% অর্থাৎ ১২৩.৮২ কোটি টাকা গ্রাহকের।
অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয় বিষয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের এক সভায় কোম্পানিটি মুনাফা দিতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন। ওই সভায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ একচ্যুয়ারি পদ্মা ইসলামী লাইফের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ বলে মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে শেয়ার হোল্ডারদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য কোম্পানির সার্বিক অবস্থা বিষয়ে সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জকে চিঠি দেয়ার কথাও জানান তিনি।
উল্লেখ্য গত বছর ১৪ জুলাই বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে অনুষ্ঠিত পদ্মা ইসলামী লাইফের পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের এক সভায় কোম্পানির চেয়ারম্যান ড. এবিএম জাফর উল্লাহ অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করবেন ও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে চাপ দিবেন বলে জানান।
অথচ চলতি বছরেও মাঠ পর্যায়েই কমিশন ও অন্যান্য সুবিধা বাবদ ১০৭.৭৫% পর্যন্ত ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানিটি। এছাড়া গত বছরের হিসেবে অনুসারে কোম্পানির পরিচালনার প্রশাসনিক ব্যয় রয়েছে আরো ৪০ শতাংশ। সবমিলিয়ে কোম্পানিটির প্রিমিয়াম সংগ্রহে ২০১৫ সালেও ব্যয় দাড়াবে সর্বোচ্চ ১৪৭.৭৫ শতাংশ।
সূত্র মতে, পদ্মা ইসলামী লাইফের ভারপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী চৌধুরী ওয়াসিউদ্দিন স্বাক্ষরিত এক অফিস বিজ্ঞপ্তিতে ( সূত্র: পদ্মা/ প্র: কা:/ উ: প্র:/ এম.ডি/ ২৭৮/২০১৫) ১০০.৪ শতাংশ কমিশন ঘোষণা করা হয়।
ওই অফিস বিজ্ঞপ্তিতে আইনগতভাবে কমিশন ভোগি মাঠ কর্মীদের ৩টি স্তরে ১ম বর্ষে ১৫ থেকে ১৯ বছর মেয়াদী পলিসিতে কমিশন ও অন্যান্য সুবিধা ধরা হয় ৬১% । এর মধ্যে ফিনান্সিয়াল এ্যাসোসিয়েট পাবেন ৩৪% ইউনিট ম্যানেজার পাবেন ১৫.৭০% ও ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পাবেন ১১.৩০%।
এছাড়া ব্রাঞ্চ কো-অডিনেটরের জন্য কমিশন ও অন্যান্য সুবিধা দেয়া হয় ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৮.৭৫% ডিস্ট্রিক্ট কো-অডিনেটর ৭.২৫%, রিজিওনাল কো-অর্ডিনেটর ৬.৭৫%, জোন ইনচার্জ ৭.৫০%, ডিভিশনাল কো-অর্ডিনেটর ৫.৭৫% ও জোনাল হেডকোয়ার্টার ইনচার্জ ৭.২৫%। এর এর সঙ্গে রয়েছে জোন, জোনাল হেডকোয়ার্টার ইনচার্জ, এ.এম.ডি (উ:), এসএএমডিদের (উন্ন) জন্য গাড়ির জ্বালানী বাবাদ ৩.৫০%। অর্থাৎ এজেন্টের ওপরে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৬.৭৬%। সবমিলিয়ে শুধু মাঠ পর্যায়েই ব্যয় দাড়ায় ১০৭.৭৫%।
বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছে, যেসব লাইফ বীমা কোম্পানি গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধ করতে পারছে না এর জন্য কোম্পানিগুলোর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনা ব্যয় দায়ী।
এদিকে আইডিআরএ বলছে অবৈধভাবে ব্যয় করার কারণে কোম্পানিগুলো গ্রাহকের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। গ্রাহকদের কোনো মুনাফাও দিতে পারছে না।
আইডিআরএর মতে, লাইফ বীমা কোম্পানিগুলো অবৈধভাবে যে ব্যয় করছে তার ৯০% গ্রাহকের টাকা। উল্লেখ্য বীমা আইন ২০১০ অনুসারে ১ম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের ৩৫% ও ও ২য় বর্ষে নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের ১০% ও পরবর্তী বছরের জন্য ৫% হারে কমিশন বাবদ ব্যয় করতে পারে। এছাড়া বীমা বিধিমালা ১৯৫৮ অনুসারে কমিশন ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ সর্বোচ্চ ব্যয় করতে পারে প্রথম বর্ষে মোট প্রিমিয়াম সংগ্রহের ৯৭.৯৮%।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৪ সালে পদ্মা লাইফ ৫২ কোটি টাকার প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২৬ কোটি টাকার প্রিমিয়াম সংগ্রহই ভূয়া। মূলত অবৈধভাবে কমিশন হাতিয়ে নিতেই এ ভূয়া প্রিমিয়াম সংগ্রহ দেখানো হয়।
প্রকৃত পক্ষে কোম্পানিতে প্রিমিয়াম আয় হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। বাকি প্রায় ২৬ কোটি টাকাই ভূয়া ব্যবসা। এই ২৬ কোটি টাকার ওপর ১২৭% ব্যয় দেখানো হয়। যার মধ্যে ১০০ টাকা সমন্বয় করে বাকি ২৭% নগদ আত্মসাৎ করে কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিচালকরা। এতে কোম্পানি থেকে পরিচালকরা গত বছরে ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ ওঠেছে । এছাড়া কোম্পানির বেতন ভু্ক্ত উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি চক্র এই বছরে কমিশন বাবদ হাতিয়ে নেয় ৩০ লাখ টাকা।
এদিকে অবৈধভাবে ব্যয় দেখিয়ে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিলেও বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) কাছে প্রকৃত তথ্য দেয়নি কোম্পানিটি। আইডিআরএর কাছে দাখিল করা হিসেবে দেখানো হয়েছে কোম্পানিটি ২০১৪ সালে কমিশন বাবদ ব্যয় করেছে ২৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানিটি কমিশন বাবদ ব্যয় করেছে ৬৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
এসব বিষয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান ডা. এবিএম জাফর উল্লাহ’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি বলেন গত ১৩ মে কমিশন সংক্রান্ত যে সার্কুলার জারি করা হয়েছে তা আইডিএরএর নিয়ম মেনেই কমিশন নির্ধারণ করা হয়েছে। মোবাইল বিল ও অন্যান্য ব্যয় সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এত বেশি বুঝলে মুশকিল।
ভূয়া ব্যবসা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো কোম্পানিতেই ৫০% বেশি নবায়ন আসে না, তাহলে তাদের বাকি ব্যবসা কি ভূয়া?