এসবিসি-কোম্পানি দেনা পাওনা: বীমা দাবি পেতে ভোগান্তি গ্রাহকের

নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোর পূন:বীমার দাবির বড় অংকের পাওনা পরিশোধ করছে না পূন:বীমাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশন (এসবিসি)। অন্যদিকে এসবিসি বলছে ননলাইফ বীমা কোম্পানিগুলো পূন:বীমার প্রিমিয়াম বাবদ পাওনা ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধ করছে না। আর উভয়ের এ পাল্টাপাল্টি দেনা-পাওনার জটিলতায় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বীমা গ্রাহককে। আইন অনুসারে, নন-লাইফ বীমা কোম্পানিগুলোকে যে কোন বীমা ঝুঁকির পলিসির অন্তত ৫০ শতাংশ পুনঃ বীমা করতে হয় এসবিসি’র সঙ্গে। একটি চুক্তির আওতায় এসবিসি এ জন্য প্রিমিয়াম পায়। কোন পলিসির বীমা দাবি উঠলেও পুণ:বীমাকৃত ঝুঁকির অংশের বীমা দাবি পরিশোধ করতে হয় এসবিসিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৪৫টি বেসরকারি নন-লাইফ বীমা কোম্পানি রয়েছে।এর মধ্যে ৫/৬টি কোম্পানির ৫০% পূন:বীমা চুক্তি এসবিসি’র সঙ্গে। বাকি সকল কোম্পানি ১০০% ই এসবিসি’র সঙ্গে পূন:বীমা চুক্তি রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন মূখ্য নির্বাহী বলেন, প্রকৃত পক্ষে কোম্পানিগুলোর কাছে এসবিসি’র পাওনা কত, আর ক্লেইম বাবদ এসবিসি’র কাছে কত টাকা পাওনা এর কোনো সঠিক তথ্য নেই। তবে কোম্পানি ও এসবিসি’র এ দেনা পাওনায় ক্ষতি গ্রস্ত হচ্ছে গ্রাহক। এসবিসি’র কাছে পাওনার অজুহাত দেখিয়ে অনেক গ্রাহককে দাবি পরিশোধে হযরানি করা হয় এমন অভিযোগ অহরহই আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, বীমা চুক্তি অনুযায়ী বীমা গ্রহীতার ক্ষয়ক্ষতি হলে তা পূরণে বীমা দাবি করলে যথাসময়ে তা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু এসবিসি সে ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা করে। অনেক সময় বীমা দাবির ফাইল না দেখে ফেলে রেখে দেয়। এতে কোম্পানিগুলো গ্রাহকের কাছে জবাব দিতে পারে না। কোম্পানিগুলো এসবিসি’র কাছে কত টাকা পাবে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কো.(বিজিআইসি)’র মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা আহমেদ সাইফুদ্দিন চোধুরী বলেন, এটা বলা মুশকিল। অন্য কোম্পানির কথা আমি বলতে পারি না। তবে বিজিআইসি এসবিসি’র কাছে ক্লেইম বাবদ পায় আনুমানিক ১২ কোটি টাকা। তবে এসবিসি কোম্পানিটির কাছে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা পাবে, জানালেন তিনি । এসবিসি’র দাবি, বেশিরভাগ কোম্পানিই চুক্তি অনুযায়ী প্রিমিয়ামের টাকা দেয় না। এসবিসি ১ জানুয়ারি ৪ বছর ভিত্তিক পাওনা প্রিমিয়ামের একটি হিসাব দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’কে । গত ১৫ মে দেয়া হিসাব বিবরণী অনুযায়ী কোম্পানিগুলোর কাছে এসবিসির পাওনা ২০১২ সালে ছিল ১৭৩ কোটি টাকা। এরপর ২০১৩ সালে ২২৮ কোটি, ২০১৪ সালে ২৯৬ কোটি এবং ২০১৫ সালে ৩৮৯ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। এ প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে আইডিআরএ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রিমিয়ামের এ টাকা আদায় করতে বলেছে এসবিসিকে । এসবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রেজাউল করিমকে সম্প্রতি এক চিঠিতে আইডিআরএ বলেছে, বিপুল পরিমাণ টাকা অনাদায়ি রেখে দেয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি যেমন হচ্ছে, তেমনি গোটা বীমা শিল্পেই জটিলতা দেখা দিয়েছে। আইডিআরএ এ চিঠির অনুলিপি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগেও পাঠিয়েছে। এসবিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, পুনঃ বীমার প্রিমিয়াম ও তাদের দাবি পরিশোধ একটি চলমান প্রক্রিয়া। তবে বেসরকারি সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর কাছে জমতে জমতে পাওনা দাঁডিয়েছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। তারা জানান, কোম্পানির কাছে টাকা চাইলে তারা তাদের ক্লেইমের অজুহাত দেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাদের ক্লেইমের চেয়ে প্রিমিয়াম অনেক বেশি পাওয়া যাবে। এসবিসির কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু কিছু বীমা কোম্পানি জাল-জালিয়াতি করছে এমন অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে এসবিসি’র কাছে আসা কোম্পানিরগুলোর সব পুনঃ বীমা দাবিই পরিশোধযোগ্য হয় না। তাছাড়া দাবিগুলো যাচাই বাছাই একটি দীর্ঘ মেয়াদি কাজ। ফলে প্রিমিয়াম ও দাবিকে একসঙ্গে মিলিয়ে দেখা যৌক্তিক নয়। এ প্রসঙ্গে প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী মনিরুল ইসলাম বলেন, এসবিসি’র কাছে কোম্পানিগুলোর যে দাবি রয়েছে তা এসবিসি সমাধান না করে ফেলে রাখে। এতে কোম্পানিগুলোও হতাশ হয়ে প্রিমিয়াম ধরে রাখে। যে কারণে বর্তমানে বড় ধরনের একটি ফিগার দাঁড়িয়েছে। তারপরেও বলবো যে ফিগারের গুনঞ্জন শোনা যাচ্ছে, হিসাব করলে দেখা যাবে তা অনেক নিচে নেমেছে। কোনো মতেই তা ৪০০ কোটি টাকা হবে না। বড়জোর ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা হতে পারে। এসবিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, বিষয়টি বহু বছর থেকে চলে আসছে। কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ পুনঃ বীমা দাবির টাকাও এসবিসি’র কাছে রয়েছে। প্রিমিয়াম দেয় না বলে আটকে রয়েছে তাদের পুনঃ বীমা দাবিও। তবে তিনি বলেন, আমরা কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত তাগাদা দিচ্ছি। তবে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না। এর জন্য সময় লাগবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এসবিসির অর্থ ও হিসাব, পুন: বীমা হিসাব ও পুঁজি বিনিয়োগ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার মো. আবদুস সালাম জানান, বীমাকারীদের ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে হিসাব বিবরণি তৈরি করতে হয়। ৩ মাস শেষ হওয়ার পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে এ বিবরীণ পাঠাতে হয় এসবিসির কাছে। এ কাজটিও যথাযথভাবে অনেক সময় পরিপালিত হচ্ছে না। পাওনা ও দেনা বিষয়ে তিনি বলেন, কোম্পানিগুলোর কাছে করপোরেশন যেমনি প্রিমিয়াম বাবদ টাকা পায়, কোম্পানিগুলোও তেমনি ক্লেইম বাবদ টাকা পায়। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। যা এক সঙ্গে কখনোই নিষ্পত্তি করা যাবে না। অনুমান করে বলা হচ্ছে কোম্পানিগুলোর কাছে এসবিসি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা পায়। আবার কোম্পানিগুলোও এসবিসির কাছে সমপরিমান না হলেও কম বা বেশি টাকা পেতে পারে। যা সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না বলে তিনি মন্তব্য করেন। কোম্পানিরগুলোর কাছে পাওনা কত এর সঠিক হিসাব পনুঃবীমা বিভাগের ডিজিএম সুধাংসু কুমার হালদারের কাছে পাওয়া যাবে, বললেন তিনি। তবে পনুঃবীমা বিভাগের ডিজিএম শুধাংসু কুমার হালদারের কাছে গেলে তিনি বলেন, এটা আমার কাছেও নেই। কার কাছে পাওয়া যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জেনারেল ম্যানেজার বিবেকানন্দের কাছে আছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ও বলেন, এটা আমার কাছে কেনো থাকবে। যারা আমার কাছে পাঠিয়েছেন, আমি তো তাদের কাছ থেকে এসব তথ্য নিয়ে থাকি। তাছাড়া আমি আপনাকে এ তথ্য কেনো দেবো। এটা বিজনেস পলিসি। কেউ কি কারোর বিজনেস পলিসি অন্যকে দেয় বলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন। তবে তিনি বলেন, বীমা একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা সহজে শেষ হয় না বরং তা চলতে থাকে। যে ফিগারের কথা বলা হচ্ছে তা কখনো স্থির থাকে না। প্রতিনিয়ত আপডেট হয়। তিনিও অন্যদের মতো বলেন, উভয় উভয়ের কাছে পাওনা রয়েছে। প্রকৃতভাবে হিসাব করলে দেখা যাবে উভয়ের পাওয়া প্রায় সমান। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কো. লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ সাইফুদ্দিন চোধুরী বলেন, বীমা সব সময় চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে। চুড়ান্তভাবে কোনো ফিগার বলা মুশকিল। এসবিসি যেমন বলছে, কোম্পানিগুলোর কাছে তাদের অনেক টাকা পাওনা আছে। এটা যেমন ঠিক, আবার এটাও ঠিক যে, এসবিসি’র কাছে কোম্পানিগুলোর ও অনেক টাকা ক্লেইম বাবদ পাওনা আছে। দুই পাওনা হিসাব করলে প্রকৃত অবস্থা জানা যাবে । তবে তিনি অনুমান করেন যে, করপোরেশ বলছে, ৪০০ কোটি টাকা প্রিমিয়াম পাবে। এই ফিগার ঠিক না। কারণ দাবির টাকাও হিসাব করলে দেখা যাবে এটা প্রায় সমান সমান। তিনি আরো বলেন, দাবির টাকা সহজেই নিষ্পত্তি হয় না। এটা হলে এসবিসি কখনো এমন ফিগার বলতে পারবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অগ্রণী ইনস্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী মো. আনোয়ার হোসাইন বলেন, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা কখনো স্থির থাকে না। সব সময় ট্রানজিকশন হতে থাকে। চুড়ান্তভাবে বলা যাবে না আসলে কোম্পানি বেশি পায়, না এসবিসি বেশি পায়। গ্লোবাল ইনস্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী মো. মোশারফ হোসাইন বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এটা আমাদের রি-ইনন্স্যুরেন্স বিভাগ বলতে পারবে। স্টার্ন্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সে মূখ্য নির্বাহী অমর কৃঞ্চ সাহা বলেন, আমাদের বিষয়ে কোর্টে মামলা চলছে। কোর্ট সিদ্ধান্ত দিলে প্রকৃত বিষয় জানা যাবে। এছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না।