১ম কিস্তি
মঙ্গাপিড়িত বলে খ্যাত উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী থানার হত দরিদ্র কয়েক হাজার গ্রাহকের কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। গুটিয়ে নিয়ে এসেছে এ অঞ্চলে সব শাখা অফিস। এর ফলে গ্রাহকরা মৃত্যুদাবি, মেয়াদোত্তীর্ণ দাবি, অন্তবর্তীকালিন দাবি কোনো টাকাই পাচ্ছে না। এমনকি যেসব পলিসি চালু আছে তার কিস্তির টাকা জমা দিতেও পারছে না তারা। এতে কয়েক কোটি টাকা খুইয়ে দিশেহারা ওই এলাকার বীমা গ্রাহকরা। নাগেশ্বরী ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমীনে ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
এর ফলে বীমার প্রতি পুরো অঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
উপজেলা দু’টিতে ২০০৩ সাল থেকে পলিসি করতে শুরু করে বায়রা লাইফ। দুই উপজেলায় ব্রাঞ্চ অফিস করে ১৪টি। প্রতি ইউনিয়নেই অফিস করে কর্মী নিয়োগ দেয় কোম্পানিটি। এর মধ্যে ভূরুঙ্গামারীতে ৭টি ও নাগেশ্বরীতে ৭টি।
কিন্তু ২০১২ সাল থেকেই এ এলাকা থেকে অফিস গুটাতে শুরু করে বায়রা লাইফ। বর্তমানে নাগেশ্বরী থানায় ১টি অফিস থাকলেও এ অফিসটিও গুটাতে ইতোমধ্যেই প্রস্তুুতি নিচ্ছে বলে জানায় বায়রা লাইফের এক মাঠ কর্মী।
জানা গেছে, ভূরুঙ্গামারীর দিয়াডাঙ্গা গ্রামের কুলসুম বেগম ২০০৭ সালে ৫০ হাজার টাকার একটি পলিসি করেন। পলিসি নাম্বার ০১০০০৭০৬৭-২। এই পলিসির ষান্মসিক কিস্তি দিতেন ২৯৪৩ টাকা করে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি ৬টি কিস্তি জমা করেন। এরপর এই পলিসিটির আর কোনো টাকা জমা নেয়নি বায়রা লাইফ। টাকা ফেরতও দেয়নি। বায়রা লাইফের কোনো এজেন্টও কুলসুম বেগমের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। কুলসুম বেগম জানান, দ্বিগুন লাভের প্রলোভন দিয়ে পলিসি করায় বায়রা লাইফ। এখন মেয়াদ শেষ হলেও কোনো টাকা দিচ্ছে না বায়রা লাইফ।
একই গ্রামের কেরামত আলী ২০০৪ সালে ২৮ নভেম্বর ৩৬ হাজার টাকার একটি বীমা পলিসি করেন। প্রিমিয়াম বাবদ প্রতি মাসে কেরামত কিস্তি দিতেন ৩০০ টাকা।১০ বছর মেয়াদী এই পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২৮ নভেম্বর ২০১৪ সালে। আট মাস আগে মেয়াদ শেষ হলেও আজো কোনো টাকা পায়নি কেরামত।
এ ধরণের অভিযোগ শত শত গ্রাহকের। গ্রাহকরা দলে দলে এসে পলিসির নথিপত্র জমা দিয়ে টাকা ফেরত পেতে এই প্রতিবেদকের কাছে সহায়তা চান।
মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নির্বাহী রশিদ দেয়া হলেও গত এক বছরে কোনো টাকা দেয়া হয়নি। আজ দিচ্ছি কাল দিচ্ছে বলে গ্রাহককে মাসের পর মাস হয়রানি করা হচ্ছে। নির্বাহী রশিদ পেয়েছে কিন্তু টাকা ছয় মাসের বেশি সময় পার হলেও টাকা পায়নি এমন গ্রাহকই রয়েছে কয়েকশত।
কিন্তু ওই এলাকার কিছু গ্রাহকের কাছ থেকে এখনো প্রিমিয়ামের টাকা জমা নিচ্ছেন এক সময়কার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন।
আনোয়ার হোসেন জানান, বায়রা লাইফ ২০১২ সাল থেকে অফিস গুটাতে থাকে।আমি বায়রা লাইফের তেমন কোনো কাজ করি না। তার মধ্যেই পরিচিত যেসব গ্রাহক রয়েছে তাদের টাকা ফেরত দেয়ার বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এখন এই এলাকার মধ্যে শুধু নাগেশ্বরীতে একটি অফিস আছে। শুনছি তাও বন্ধ করে দেয়া হবে।
আনোয়ার হোসেন আরও বলেন, কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে যোগাযোগ করলেই তারা বলে টাকা ফেরত দেয়া হবে। ঈদের আগে ১৭০ জন গ্রাহকের দাবি জমা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২ জন গ্রাহককে দাবির চেক দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এখনো কোনো টাকা পায় নাই।
এই এলাকায় ২০০৩ সালের দিকে বায়রা লাইফ কাজ শুরু করে। তখন কলেজের শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা অনেকেই এর সঙ্গে জড়িত ছিল। এখন কেউ গ্রাহকদের খোঁজ খবর নেয় না। একমাত্র আমি আছি। নানা দেন দরবার করে দু’একজন গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার চেষ্টা করছি, বললেন আনোয়ার।
বিষয়টি নিয়ে বায়রা লাইফের চেয়ারম্যান আবুল বাশারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে লাইন কেটে দেন। পড়ে মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে বায়রা লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মূখ্য নির্বাহী শফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, খুব শিগগিরই টাকা ফেরত দেয়া হবে। এ বিষয়ে বোর্ডে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বীমা বিশেষজ্ঞরা বলেন, কোনো কোম্পানিতে টাকা আত্মসাৎ ও লুটপাটের ঘটনা হলেই কোম্পানি গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারে না। বীমা আইন মেনে ব্যবসা করলে গ্রাহকের টাকা ফেরত নিয়ে কোনো সমস্যাই হওয়ার কথা না। বায়রা লাইফ উত্তর বঙ্গে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে তার দায়ভার এখন সকল কোম্পানিকেই নিতে হবে। ওই এলাকার গ্রাহকরা বীমার প্রতি আস্থা হারাবে। ফলে অন্য কোনো কোম্পানিও ওই এলাকায় নতুন করে পলিসি করতে পারবে না।
এ বিষয়ে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র হস্তক্ষেপের কথাও বলেন তারা।