সার্ভিস চার্জের নামে প্রাইম ইসলামী লাইফের প্রতারণা: নির্বিকার আইডিআরএ
কক্সবাজার জেলার টেকনাফের মনোয়ারা বেগম। ইসলামী শরীয়া মোতাবেক পরিচালিত বলে প্রতারিত বা বঞ্চিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই এ বিশ্বাসে ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস) নামে বীমা করে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে। কিন্তু মেয়াদ শেষে তার কাছ থেকে নানা হিসাবের মাধ্যমে অবৈধভাবে কেটে রাখা হয়েছে ১ হাজার ৪৮৫ টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৫ সালের ২৭ মার্চ থেকে শুরু হয় মনোয়ারা বেগমের ডি ০০০০০৭৯৬৩-১ নম্বর পলিসিটি। মাসিক ৩০০ টাকা কিস্তি হিসেবে ১২০টি কিস্তি দিয়ে মনোয়ারা জমা করেন ৩৬ হাজার টাকা। ২০১৫ সালের ৬ মার্চ তার বীমা মেয়াদ পূর্তি হয়। এরপর বীমা দাবি উত্থাপন করলে কোম্পানিটির কাছ থেকে বীমা দাবি পরিশোধের নির্বাহি রশিদ পায়। এতে মনোয়ারা দেখতে পায় তার জমা করা ৩৬ হাজার টাকার বোনাস দেয়া হয়েছে ১২ হাজার ৪২০ টাকা। এর থেকে হ্রাসকৃত বোনাস নামে কাটা হয়েছে ৩৮৫ টাকা এবং সার্ভিস চার্জ কাটা হয়েছে ১ হাজার ৮০ টাকা। ৩৬ হাজার টাকা জমা করার পর মাত্র ১২ হাজার ৪২০ টাকা বোনাস দিয়ে তা থেকে হ্রাসকৃত বোনাস আর সার্ভিস চার্জের নামে কেটে রাখা হয়েছে ১ হাজার ৪৮৫ টাকা।এ ছাড়াও আয়কর কাটা হয়েছে ৫৪৮ টাকা।
অনুসন্ধানে কোম্পানিটির সার্ভিস চার্জ কেটে রাখার বেশ ক’টি প্রমান পাওয়া গেছে।
এভাবে সার্ভিস চার্জের নামে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বেসরকারী জীবন বীমা কোম্পানি প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স।ইসলামের নাম ভাঙিয়ে সহজ সরল মানুষদের আকৃষ্ট করে ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডিপিএস) নামে বেআইনি এক প্রকল্প খুলে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে এ বীমা কোম্পানিটি।
এসব প্রতারণার বিরুদ্ধে গ্রাহকের অভিযোগ এবং গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাদের।
ফলে জনসাধারণের কাছে বীমা খাতের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে ইসলামের দোহাই দিয়ে বীমা করিয়ে এ ধরণের প্রতারণা করায় মহান ধর্ম ইসলামকে অপমান করা হচ্ছে।
অথচ বীমাখাতে কোম্পানিগুলোর আর্থিক অনিয়ম, বেআইনি কার্যক্রম দেখভাল ও নিয়ন্ত্রণ এবং গ্রাহকদের সঙ্গে যে কোন ধরণের প্রতারণার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ(আইডিআরএ’র)।
মেয়াদ শেষে গ্রাহককের পাওনা পরিশোধ করার সময় অবৈধভাবে সার্ভিস চার্জ কেটে রাখছে প্রাইম ইসলামী লাইফ। অথচ বীমা আইনে পলিসির মেয়াদ শেষে দাবি পরিশোধের সময় সার্ভিস চার্জ কেটে রাখার কোনো বিধান নেই। গ্রাহকের সঙ্গে এ ধরণের প্রতারণা ঠেকাতে আইডিআরএ কে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে বীমা আইন-২০১০ এ।
উল্লেখ্য বীমা আইন ২০১০ এর ১৬ ধারার বিভিন্ন উপ ধারায় বলা হয়েছে, প্রিমিয়াম হার ও অন্যান্য শর্তাবলী গ্রহনযোগ্য না হলে পলিসিটি(বীমা পরিকল্প)টি বাজারে বিক্রি বন্ধ করতে বা পরিবর্তন করার নির্দেশ দিতে পারে আইডিআরএ।এ আইন না মানলে কোম্পানিকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করার ক্ষমতাও রয়েছে আইডিআরএ’র হাতে।
সার্ভিস চার্জ কেটে রাখার বিষয়ে প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মোরতুজা আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি কোম্পানির দাবি বিভাগে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। দাবি বিভাগের প্রধান আজরার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের কিছু পরিকল্প আছে যেখানে লেভেল প্রিমিয়াম নেয়া হয়। লেভেল প্রিমিয়ামের কারণেই সার্ভিস চার্জ কেটে রাখা হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, পরিকল্পটি ডিজাইন করে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী একচুয়ারী আফসার উদ্দিন। তিনি যেভাবে প্রিমিয়াম ও অন্যান্য শর্ত আরোপ করেছেন কোম্পানি সেভাবেই দাবি টাকা পরিশোধ করছেন। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোম্পানির অপর এক কর্মকর্তা বলেন, লেভেল প্রিমিয়াম নেয়ার দোহাই দিয়ে যে সার্ভিস চার্জ কেটে রাখা হচ্ছে তা ঠিক নয়।
বীমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিকল্পের ক্ষেত্রে দু্ইভাবে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। একটি স্বাভাবিক প্রিমিয়াম ও সমহার প্রিমিয়াম। স্বাভাবিক প্রিমিয়াম নেয়ার পদ্ধতিতে গ্রাহকের বয়স ও ঝুকির পরিবর্তনে শর্তাবলী পরিবর্তন করা হয়। অন্যদিকে সমহার পদ্ধিতিতে একটি পলিসির মেয়াদ অনুসারে সমহারে প্রিমিয়াম নেয়া হয়। তাদের মতে, এই দুই ধরণের প্রিমিয়াম নেয়ার ক্ষেত্রেই সার্ভিস চার্জ নেয়ার কোনো বিধান নেই।বীমা চুক্তিতে মেয়াদ শেষে সার্ভিস চার্জ কেটে রাখা অবৈধ।
বীমা বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, বাংলাদেশে সব কোম্পানি সমহার পদ্ধতিতে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে থাকে। কোনোটিতেই মেয়াদ শেষে সার্ভিস চার্জ কেটে রাখার শর্ত নেই।
আইডিআরএর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "লাইফ বীমার ক্ষেত্রে নির্ধারিত কোনো প্রিমিয়াম হার নেই। ফলে কোম্পানিগুলো তাদের পছন্দ মতো প্রিমিয়াম ও পলিসির অন্যান্য শর্ত আরোপ করতে পারেন। তবে, কোনো পলিসিতে অস্বাভাবিক শর্ত দেয়া হলে তা যাচাই বাছাই বা বাতিল করতে পারে কর্তৃপক্ষ।"