পদ্মা ইসলামী লাইফের প্রতারণা: শোষিত গ্রামাঞ্চলের মানুষ, নির্বিকার আইডিআরএ

মেয়াদ শেষে দ্বিগুন টাকা ফেরত এবং ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক পরিচালিত বলে জমানো টাকার নিশ্চয়তা ও উন্নত সেবা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বীমার নামে কক্সবাজারের চকোরিয়ার প্রত্যন্ত এলাকার হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষদের শোষণ করছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। দ্বিগুন টাকা দেয়ার আশ্বাস বেমালুম অস্বীকার করে মেয়াদ শেষে জমানো টাকার অর্ধেকও কেটে রাখা হচ্ছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার ২ বা ৩ বছর পর টাকা ফেরত দিলেও পাওনা টাকা থেকে নতুন করে পলিসি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে গ্রাহক তার জমাকৃত টাকার অর্ধেকও ফেরত পাচ্ছে না। কক্সবাজারের চকোরিয়ার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পদ্মা ইসলামী  লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এ শোষণের চিত্র পাওয়া গেছে। বীমা কোম্পানিগুলো গ্রামাঞ্চলে সাধারণ নিরীহ দরিদ্র মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতে মেতে থাকলেও তা নিয়ে কোনো তৎপড়তা নেই বীমা খাতের দেখভাল করার দায়িত্ব পাওয়া সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)'র। অভিযোগ রয়েছে, দেশব্যাপী কোটি কোটি টাকার এ সব দুর্নীতি আড়াল করতেই ঢাকায় বসে বীমা কোম্পানি পরিচালনা বিষয়ে ছোট খাট দোষত্রুটি নিয়ে জরিমানা করার নামে আইডিআরএ `অনেক কিছু করে ফেলছে’ এমন ভাব দেখিয়ে প্রচারনা চালাচ্ছে। চকোরিয়া পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাকাড়া গ্রামের  বেলাল হোসেন ২০০২ সালে মাসে ২০০ টাকা কিস্তির একটি ডিপিএস পলিসি করেন পদ্মা ইসলামী লাইফে। পলিসি নাম্বার -৫৬৪০০৯০/৬। ৫ বছর পর আর্থিক সঙ্গতি না থাকায়  তিনি কিস্তি দেয়া বন্ধ করে দেন। পরে টাকা ফেরত চাইলে তাকে বলা হয় ১০ বছর পুর্ণ না হলে টাকা ফেরত দেয়া যাবে না। এরপর ১০ বছর পূর্ণ হলে টাকা ফেরত চায় বেলাল। তবে বিভিন্ন টাল বাহানায় তাকে ঘুরাতে থাকে কোম্পানিটির স্থানীয় অফিস। পরে তাকে টাকা ফেরত দেয়া হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। অথচ বীমা আইন অনুসারে ২ বছর কিস্তি দেয়ার পর গ্রাহক টাকা ফেরত চাইলে তা দিতে বাধ্য বীমা কোম্পানি। বেলাল পদ্মা ইসলামী লাইফে টাকা জমা করেন সর্বমোট ১২ হাজার টাকা। বেলালকে লাভ দেয়া হয় ১ হাজার ১২০টাকা।  বেলালের নামে কোম্পানি থেকে মোট ১৩ হাজার ১২০ টাকার চেক দেয়া হয়। তবে চেকটি বেলালের একাউন্টে জমা হওযার আগে বেলালের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকার একটি চেক নেয়া হয়। বেলালের চেকটি দেয়ার পরই বেলালের একাউন্টে কোম্পানির দেয়া টাকা জমা হয়। অর্থাৎ ৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে বেলাল তার একাউন্টে পান ৮ হাজার ১২০ টাকা। বেলালের হাতে নতুন করে একটি পলিসির মানি রিসিপট হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। এ ছাড়াও বেলালের কাছে জিডি করার নামে আরো ১ হাজার টাকা নেয়া হয়। কেন জিডি করার দরকার হলো সে সম্পর্কে কিছুই জানে না বেলাল। শাজাহান নামের পদ্মা লাইফের এক কর্মকর্তা তাকে পলিসিটি করান। বেলাল পদ্মা ইসলামী লাইফকে  ৫ হাজার টাকা দেন পূবালী ব্যাংক চকরিয়া শাখার একাউন্ট নাম্বার-বেলাল স্টোর-১৯৫৯১৩৯ এর চেক নাম্বার-এসি-৩৯০০৯০১০০৮২৯৯ মাধ্যমে। তারিখ ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪। বেলালের দেয়া চেক নগদায়ন হওয়ার ২ দিন পর অর্থাৎ ২৪ সেপ্টম্বর ২০১৪ তারিখে স্থানীয় পূর্বালী ব্যাংকের ৮২৯৯ নাম্বার একাউন্টের ৯৬৬৬০২৬ নাম্বার চেকের মাধ্যমে বেলালের একাউন্টে টাকা দেয় কোম্পানি। এ বিষয়ে বেলাল জানান, ৫ হাজার টাকার চেক না দিলে কোনো টাকা দেয়া হবে না, কোম্পানির লোকজন এমনটি বলায় তিনি ৫ হাজার টাকা চেক মাধ্যমে জমা দেন। চকোরিয়ার ইউসুফ পদ্মা ইসলামী লাইফে পলিসি করেন ২০০২ সালে। পলিসি নং ৫৬৪০০৭২/৪। পলিসির মেয়াদ শেষ হয় ২০১২ সালে। ইউসুফ পদ্মা ইসলামী লাইফে মাসিক ২০০ টাকা কিস্তি হিসেবে মোট টাকা জমা করেন ৯ হাজার ৬০০ টাকা। ইউসুফকে টাকা ফেরত দেয়া হয় ২০১৪ সালে। অর্থাৎ মেয়াদ শেষ হওযার ২ বছর পর। টাকা দেয়া হয় ১০ হাজার ১২০ টাকা। ইউসুফের বাড়ি চকরিয়ায়। কৃষি কাজ করেই দিন যাপন করেন। এক ছেলে এক মেয়ের সংসার। ছেলে মেয়ে দু’জন স্কুলে পড়ে। তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পলিসি করেছিলেন তিনি। এ বিষয়ে ইউসুফ জানান আমার কোনো দু:খ নেই। অনেক হয়রানির পর যাই হোক কিছু টাকা তো ফেরত পেয়েছি। না নিলে এটাও মার যেত। পলিসি করার সময় বলা হয়েছিল ১০ বছর পর ২৪ হাজার টাকা দেয়া হবে। এখন মূল টাকা ওঠাতে গিয়েই হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। আর্থিকভাবে লোকসানেও পড়তে হয়েছে। সময় নিয়ে তালাশ করলে চকোরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পদ্মা ইসলামী লাইফের এমন প্রতারণার ঘটনা কয়েক শ পাওয়া যাবে বলে জানালেন প্রতারিত এই দুই গ্রাহক। বীমা কাভারেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বীমা অংকের টাকা ফেরত দেয়া বাধ্যতামূলক। গ্রাহককে এ সময়ের মধ্যে টাকা ফেরত না দিলে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে বীমা আইনে। বীমা আইন-২০১০ এর ধারা ৭২এর উপধারা ১ ও ২ এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। ‘৭২৷ (১) বীমাকারী কর্তৃক ইস্যুকৃত পলিসির অধীন অর্থ প্রদেয় হয় এবং দাবী প্রদানের জন্য সমস্ত কাগজপত্র দাবীদার কর্তৃক দাখিল করা হইয়াছে এইরূপ ক্ষেত্রে বীমাকারী যদি দাবী পরিশোধের প্রাপ্য হওয়া বা দাবীদার কর্তৃক সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা পূরণের, যাহা পরে সংঘটিত হয়, ৯০ (নব্বই) দিনের মধ্যে দাবী পরিশোধে ব্যর্থ হয় তাহা হইলে উপ-ধারা (২) এ নির্ধারিত সুদ পরিশোধ করিবে, যদি না বীমাকারী এইরূপ ব্যর্থতা তাহার নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ছিল বলিয়া প্রমাণ করিতে পারে৷ (২) উপ-ধারা (১) এর অধীন সুদ ব্যর্থতাজনিত চলমান সময়ের জন্য পরিশোধযোগ্য হইবে এবং প্রচলিত ব্যাংক রেটের অতিরিক্ত শতকরা ৫ (পাঁচ) ভাগ হারে মাসিক ভিত্তিতে হিসাব করিতে হইবে৷’ অন্যদিকে গ্রাহকের আর্থিক অবস্থার কথা বিবেচনা করেই পলিসি করতে হয়। জোর করে বা প্রলোভন দিয়ে পলিসি করা বীমা আইন অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বীমা আইন ২০১০ এর ১৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘১৩৩৷ কোন ব্যক্তি বিভ্রান্তিকর, মিথ্যা বা প্রতারণামূলক বলিয়া জানেন, এইরূপ বিবরণী, আশ্বাস, পূর্বাভাস দ্বারা, বা প্রতারণামূলক বলিয়া জানেন, বা প্রতারণামূলক পূর্বাভাষ দ্বারা কোন ব্যক্তিকে কোন বীমাকারীর সহিত বীমা চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তাবে প্রলুদ্ধ করার চেষ্টা করিলে তিনি এই অপরাধে অভিযুক্ত হইবেন এবং অভিযোগ প্রমাণিত হইলে অনধিক ১০ (দশ) লক্ষ টাকা অর্থ দণ্ড বা অনধিক ৩ (তিন) বৎসরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন৷’ কড়াকড়ি আইন থাকলেও অনিয়ম প্রতিরোধ ও প্রতিকার যার হাতে সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখছে না।ফলে থামছে না বীমা কোম্পানিগুলোর প্রতারণা ও অনিয়ম। নষ্ট হচ্ছে বীমা শিল্পের ইমেজ। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বীমা কোম্পানিগুলোর মালিকদের বিশেষ একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখছে সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য ও চেয়ারম্যান। ফলে গুরুতর অভিযোগ পাওয়ার পর তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বীমা খাতে এ ধরণের দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে আইডিআরএর সদস্য ও চেয়ারম্যানের যোগ্যতা ও স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা। পদ্মা ইসলামী লাইফের এসব প্রতারণার বিষয়ে  বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কোনো সদস্য প্রকাশ্য মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম গোপন রাখার শর্তে এক সদস্য বলেন, মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে পলিসি করানোর শাস্তি ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা ৩ বছরের জেলের বিধান রয়েছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৯০ দিনের মধ্যে দাবি পরিশোধের বিধান। এ সময়ের মধ্যে দাবির টাকা পরিশোধ করা না হলে পরবর্তী দিন গুলোর জন্য ব্যাংক রেটের সঙ্গে আরো ৫ শতাংশ মাসিক ভিত্তিতে সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। পদ্মা ইসলামী লাইফ আইনের ২টি ধারা লঙ্ঘনের অপরাধ করেছে এবং এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন কি না জানতে চাইলে বিষয়টি আইডিআরএর বোর্ড সভায় তোলা হবে বলে জানান আইডিআরএ’র এ সদস্য। এ বিষয়ে পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান ডা. এবিএম জাফর উল্লাহ বলেন, এটি হয়তো বিচ্ছিন একটি ঘটনা। দ্বিগুন লাভের  প্রলোভন দিয়ে পলিসি করার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কোনো কর্মী কোনো অনিয়ম করা হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেয়া হবে।    তারিখ-১৮ মে, ২০১৫