উপকুলের হত দরিদ্রদের শেষ সঞ্চয় হাতিয়ে নিচ্ছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স
দ্বিগুন লাভের মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বীমার নামে উপকুলীয় অঞ্চলের হতদরিদ্রের কোটি কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তথাকথিত ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত দাবিদার পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স। এ বীমা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে এ অঞ্চলের নিরক্ষর, সহজ সরল মানুষ তাদের কষ্টার্জিত শেষ সঞ্চয়টুকু হারিয়ে ফেলছে।সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
এ ধরণের প্রতারণা হচ্ছে স্বীকার করলেও দায়-দায়িত্ব নিতে রাজি নয় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ।
বীমাখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র কোন নজরদারি নেই বলেই নির্বিঘ্নে চলছে বীমা কোম্পানির এ প্রতারণা, অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
উপকুলীয় দুর্গম এলাকা কক্সবাজারের মহেশখালির মোতার বাড়ি। জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই হত দরিদ্র। দরিদ্র এ জনগোষ্ঠীর আয়ের উৎস মাছ ধরা। মাছ বিক্রি থেকে যে আয় হয়, তার থেকে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখতে বেশ বেগ পেতে হয়।সপ্তাহে ৫০ টাকা অথবা মাসে ১০০ টাকা জমাতে এক আধ বেলা উপোস থাকতে হয় অনেককে।
এ সঞ্চয়টুকুতে চোখ পড়ে প্রতারক বীমা কোম্পানি পদ্মা ইসলামী লাইফের। ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত বলে এ কোম্পানিতে বীমা করলে টাকা মার যাওয়ার কোন রকম আশংকা নেই। এছাড়া বোনাস ও মেয়াদ শেষে দ্বিগুন টাকা বুঝিয়ে দেয়ার নিশ্চয়তাও রয়েছে।
এসব আশ্বাস দিয়ে এ এলাকার মানুষদের প্রলুব্দ করে ক্ষুদ্র বীমা তথা ডিপোজিট পেনশন স্কিমের পলিসি বিক্রি করা হচ্ছে। মিথ্যা প্রলোভনের এই ফাঁদে ফেলে গত ১৪ বছরে এই মোতার বাড়ি এলাকা থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় পদ্মা ইসলামী লাইফ।
গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয়া হচ্ছে সঞ্চয়ের নামে। লোভ দেখানো হচ্ছে যে টাকা জমা করা হবে ১০ বা ১২ বছর পর পাওয়া যাবে তার দ্বিগুন। ভবিষ্যতের দ্বিগুণ টাকা পাওয়ার আশায় সহজেই তারা পা দেয় ফাঁদে। অথচ তারা কোথায় কোন প্রতিষ্ঠানের নামে টাকা জমা করছে তাও জানে না।
মহেশখালির মাতার বাড়ি এলাকার এসব বীমা গ্রাহকের অধিকাংশই দরিদ্র মহিলা।
মাতার বাড়ির গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পলিসি করার আগে তাদের বলা হয় গ্রাহকদের প্রতি মাসে ১০০ টাকা পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে জমা করলে ১০ বছর পর তাকে ফেরত দেয়া হবে ২৪ হাজার টাকা। প্রতিমাসে ২০০ বা ৩০০ টাকা কিস্তি পরিশোধ করলে ১২ বা ১০ বছর পড়ে দেয়া ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। এছাড়া যারা ২০ হাজার টাকার ওপরে জমা করবে তারা ৪ বছর পর পর ৫ হাজার টাকা করে বোনাসও পাবে।
দ্বিগুন লাভের আশায় ওই এলাকার দরিদ্র এসব মানুষ খেয়ে হোক না খেয়ে হোক টাকা জমা করে আসছে। অনেক সময় কিস্তির টাকা জমা দিতে দেরি হলে তাদের কাছ থেকে জরিমানাও আদায় করা হচ্ছে। অথচ পদ্মা ইসলামী লাইফ মাসিক ১০০ টাকা সঞ্চয়ের এ পলিসিতে ১০ বছর পর ফেরত দিচ্ছে ১৩ হাজার ১৪০ টাকা। চলতি বছর পর্যন্ত গ্রাহকদের জন্য বোনাস ঘোষণা করা আছে প্রতি হাজারে ১০ টাকা। আর এ টাকাও গ্রাহক পাচ্ছে মেয়াদ শেষ হওয়ার ২ থেকে ৩ বছর পর। যার মধ্যে অর্ধেক টাকা্ নতুন একটি পলিসি করার নামে কেটে রাখা হচ্ছে। ফলে গ্রাহক ১০ বছরে ১২ হাজার টাকা জমা দিয়ে পাচ্ছে ৭ হাজার টাকা।দরিদ্র এসব গ্রাহক উপায়ান্তর না দেখে যা পাচ্ছে তাই নিতে বাধ্য হচ্ছে। না নিলে এটাকাও দেয়া হবে না বলে হুমকী দেয়া হয়।
বোনাসের নামেও প্রতারণা করা হচ্ছে গ্রাহকের সঙ্গে। পলিসি শুরুর ৪ বছর পরে যে টাকা দেয়া হচ্ছে তা মূলত গ্রাহকেরই জমানো টাকা। মেয়াদ শেষে মোট পাওনা টাকা থেকে এ টাকা কেটে রাখা হয়। এটি কোনো লভ্যাংশ বা মুনাফা নয়। অথচ গ্রাহককে বোঝানো হচ্ছে তার ৪ বছরে যে টাকা জমা করছে তা থেকে তারা ওই ৫ হাজার টাকা মুনাফা বা বোনাস পাচ্ছে।
রোকেয়া বেগম ২০০৭ সালে নভেম্বর মাসে ২০ হাজার টাকার পলিসি করে।পলিসি নাম্বার ০০০০৫০৩৮৩৪-৪। রোকেয়া বেগমকে বার্ষিক কিস্তি দিতে হয় ২১০৮ টাকা। চলতি মাস পর্যন্ত সে কিস্তি পরিশোধ করে আসছে। এখন পর্যন্ত অন্তবর্তীকালিন বোনাস পেয়েছে ২টি। তার পলিসির মেয়াদ শেষ হবে ২০১৯ সালে।
মেয়াদ শেষে কত টাকা পাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে রোকেয়া বলেন, ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
বিষয়টি নিশ্চিত করতে চকরিয়া অফিসে গিয়ে হিসাব বহিতে দেখা যায় ১২ হাজার টাকা বীমা অংকের ১০ বছর মেয়াদী একটি পলিসিতে মেয়াদ শেষে দেয়া হয়েছে ১৩ হাজার ১৪০ টাকা। অর্থাৎ ১ শতাংশ মুনাফা।এই হিসেবে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা মুনাফা পাবেন রোকেয়া বেগম। অথচ মোটা অংকের টাকা পাওয়ার আশায় বীমা করেন এই গ্রাহক।
ওই গ্রামের রাশেদা বেগম জানেনই না মেয়াদ শেষে তাকে কত টাকা দেয়া হবে। তবে আরো এক বছর পূর্ণ হলে ৫ হাজার টাকা বোনাস দেয়া হবে বলে জানান এ হতদরিদ্র নিরক্ষর মহিলা।রাশেদা বেগম ২০১১ সালে পলিসি করে। তাকে দেয়া মানি রিসিপটে পলিসির কোনো নাম্বার নেই। রাশেদা বেগমও বছরে কিস্তি দিচ্ছে ২১০৮ টাকা। টাকা জমা করার রশিদে পলিসি নাম্বারের ঘরে লেখা আছে ‘নতুন’।
মিথ্যা তথ্য দিয়ে পলিসি করার বিষয়ে কক্সবাজার জোনাল ইনচার্জ নাসির হাসানের কাছে জানতে চাওয়া হলে বিষয়টি অস্বীকার করেন নাসির। তিনি বলেন, আমাদের কোম্পানিটি ইসলামী বীমা কোম্পানি। এ কারণে কত টাকা লাভ দেয়া হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
এ বিষয়ে কোম্পানির চেয়ারম্যান ডা. এবিএম জাফরুল্লাহ বলেন, দ্বিগুণ মুনাফা দেয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। এ ধরণের কথা বলে কেউ পলিসি করালে তার দায়িত্ব আমাদের নয়। আমাদের প্রতি হাজারে ১০ টাকা হারে বোনাস ঘোষণা করা আছে। এই হিসেবে ১২ হাজার টাকা বীমা অংকের একটি পলিসিতে এক দেড় হাজার টাকা বোনাস পেতে পারে। মেয়াদ পূর্ণ হওযার তিন বছর পর টাকা পরিশোধ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এত দেরি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা।
তারিখ-১০ মে, ২০১৫