মোস্তাফিজুর রহমান টুংকু:
সে কোন দ্যাশ থেইক্যা একটা লোক আইসে ছিল। লম্বা দাড়ি, কি সুন্দর চেহারা, হাতে কোরআন শরীফ, এই খানে মসজিদের এক হুজুর ছিল। তারে সাথে কইরে নিয়ে আইসল। আমি একটু কতা কইতে পারি। তাই বইলল সদস্য হইতে।
আপনি কতা বেশি জানেন। তাই পারায় পারায় যাইয়ে লোক ডাইকা আনবেন। আপনার বেতন দিব। এতে যা হইবে তত। তার পর বইলল টাকা দিতে হবে। আমি বইললাম টাকা নাই, পরে ৩৩৫ টাকা ছিল তাই দেলাম।
২৫ জন সদস্য হইয়েছিল। আম্যারে বইলে ছিল, যে যেমন টাকা দিবে তেমন বেতন পাবি। আমার টাকা পয়সা নেই তো, গরীব মানুষ, টাকা দিতে পারিনি, বেতন থেইকে কাটি রেখে ছিল। ২৫ জন ট্যাকা দিয়েছিল কেউ ৫০০ কেউ ১০০০। পরে পালাই গেল।
এমনভাবেই কথা বলছিল উত্তর ভবানীপুর গ্রামের মহিমা। মহিমা ও অন্যান্যরা যাদের হাতে টাকা দিয়েছিল তাদের নাম কেউ জানে না। কোম্পানির নামও জানে না। তবে এখন কোম্পানির পাস বইটি তার কাছে রক্ষিত আছে। আর পাস বইটি প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের।
উত্তর ভবানী পুরের অশিক্ষত সরল গ্রামবাসীরা। শেলাই শেখানোর পাশাপাশি হাতের কাজ শেখানোর কথা বলে এক ব্যক্তি গ্রামের ২৫ জন মহিলার পলিসি করে। পরে পালিয়ে যায়।
হাতে কোরআন শরীফ ছিল লোকটার। নামাজও পড়তেন তিনি। তার সাথে ছিল ওই গ্রামেরই মসজিদের ইমাম। তাদরে কেউ চিনত না। কোথা থেকে এসছিল তা বলতে পারে না উত্তর ভবানী পুরের অশিক্ষত সরল গ্রামবাসীরা।
মহিমার ওই দলের আরেক সদস্য লাইলি। লাইলি এখন আর এ গ্রামে থাকে না। বিয়ের পর এখন সে শশুর বাড়িতে। লাইলির ভাই মাহফুজুর জানালেন, যারা সদস্য হয়েছিল তাদের মধ্যে আপাই একটু পড়াশুনা জানত। সে ৭ /৮ বছর আগের কথা। আমরা কোনো কাগজপত্র রাখিনি। সব ফেলে দেয়া হয়েছে। লাইলি ৮০০ টাকা জমা করেছিল। কথা ছিল কোম্পানির লোকেরা সেলাই শিখাবে। হাতের কিছু কাজ দিবে। কিন্তু একদিন ভেড়ামারায় গিয়ে দেখা গেল লাপাত্তা। তারা পালিয়ে গেছে।
একই ভাবে ওই গ্রামেরই গৃহবধু তানিয়া পারভীন ২৫০০ টাকা জমা করেছিল সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে। তবে প্রথমবার যে ১ হাজার টাকা জমা করেছিল তা ঠিক ভাবে মনে থাকলেও পরের ঠিক কত টাকা জমা করেছিল তা মনে নেই তানিয়ার।
পরে আর কেন টাকা জমা করলেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে তানিয়া বলেন, আমাদের ভিডিও করল, ছবি তুলল। তা আবার আমাদের দেখালো। আমাদের সেলাই মেশিন দেয়ারও কথা ছিল। আর পরে টাকা তো জমা দিতে পারি নি। টাকা জমা দিব কোত্থেকে? তারা তো সব পরে পালিয়ে গেল।
শুধূ উত্তর ভবানীপূর গ্রামই নয়, আশাপাশের গ্রামেও রয়েছে এমন ঘটনা।
এ বিষয়ে বীমা বিশ্লেষকরা বলেন, ২০০০ সালে দেশে নতুন ডজনখানেক লাইফ বীমা কোম্পানির লাইসেন্স দেয়া হয়। দেশের ছোট বীমা বাজারের জন্য যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। ফলে ব্যবসায় নেমে তীব্র প্রতিযোগিতার মূখে পড়ে নতুন কোম্পানিগুলো। দেশব্যাপী জনমূখী বীমা, বন্ধুবীমা, গণমূখি বীমা, ইত্যাদি নানা বাহারি নামে শাখা অফিস খুলে বসে কোম্পানিগুলো।
এসব শাখা অফিসে স্বল্পশিক্ষিত, অনভিজ্ঞ এবং বীমা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এমনকি ধারণাহীন লোকদের নিয়োগ দেয়া হয়। এসব লোকদের হাতেই তুলে দেয়া হয় প্রিমিয়াম সংগ্রহের পিআর বহি । যার কোনো নিয়ন্ত্রণ কোম্পানিগুলোর ছিল না। এসব কর্মীরাই নানা প্রলোভন এমনকি ধর্মীয় অনুভুতি কাজে লাগিয়ে বীমা করার অনুপযুক্ত লোকদের পলিসি করায়। অন্যদিকে অতি মুনাফার লোভে কোম্পানিগুলোও এ বিষয়ে কোনো নজরদারি করে না। ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বীমা বিশেষজ্ঞরা।