উত্তর ভবানীপুর: গ্রামবাসীরা কেউ বীমা বিশ্বাস করে না

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন:পর্ব- ১ মোস্তাফিজুর রহমান টুংকু: রেকেন আলী মারা গেছেন ৫ বছর আগে। কিন্তু আজও জীবন বীমার কোম্পানির টাকা পায়নি তার পরিবার। সংশ্লিষ্ট বীমা কোম্পানির যে কর্মকর্তা রেকেনের বীমা করেছিল, সে এখন আমেরিকায়। এরপর কোম্পানির কোন লোক খোঁজ করেনি। বারবার তাগাদার পরও সাড়া দেয়নি কোম্পানি। এদিকে মাটির ঘরে কতদিন কাগজ আগলে রাখা যায়। বীমার যে কাগজ রেকেনের স্ত্রী আগলে রেখেছিল, তা ইঁদুরে খেয়েছে। সব কাগজ না পেলে বীমার মৃত্যু দাবির টাকা পরিশোধ করা যাবে না বলে জানিয়েছে কোম্পানি। কিস্তি পরিশোধ করার পরও বীমা দাবি না পাওয়ায় দিশেহারা রেকেনের স্ত্রী। রেকেনের মতোই উত্তর ভবানীপুর গ্রামের মোহন, শিমন হোসেন, সুরভীসহ পুরো গ্রামের কেউই বিশ্বাস করে না বীমা কোম্পানির লোকজনকে। তাদের বিশ্বাস ছিল মারা যাওয়ার পর পাওয়া যায় টাকা। অথচ দ্বিগুণ মুনাফাসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে শত শত গ্রাহককে পলিসি করিয়ে টাকা নিয়েছে বীমা কোম্পানি। কিন্তু মেয়াদপূর্তির পরও পাওনা টাকা না পাওয়ায় এভাবেই ইন্সুরেন্সনিউজবিডির কাছে হতাশার কথা জানান ওই গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকরা। বিভিন্ন বীমা কোম্পানির কাছ থেকে এমনই প্রতারণার শিকার গ্রামের অধিকাংশ মানুষ।তাই এখন আর তারা বীমাকে বিশ্বাস করে না। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা। উপজেলা সদর থেকে ধরমপুর ইউনিয়নের দূরত্ব ৬ কিলোমিটার। এই ইউনিয়নেরই গ্রাম উত্তর ভবানীপুর। গ্রামের জনসংখ্যা ৪ হাজারের বেশি। এ গ্রামের সবাই কোন না কোন কোম্পানির পলিসি করেছে। যাদের অধিকাংশই মহিলা। এমন অনেকে রয়েছে, যারা বিয়ের আগে বীমা করেছে। এখন বিয়ে হয়ে অন্য গ্রামে চলে গেছে। জীবনের প্রয়োজনে গ্রাম ছাড়লেও বীমার প্রতি তাদের বিশ্বাস ফিরে আসেনি। উত্তর ভবানীপুর গ্রামের দরিদ্র অশিক্ষিত বীমার গ্রাহকদের ভোগান্তি নিয়ে ইন্সুরেন্সনিউজবিডি’র ধারাবাহিক আয়োজন। প্রথম কিস্তি সাজানো হয়েছে, মোহন, শামুন হোসেন ও সুরভীর কাহিনী নিয়ে। এরা সবাই ডেল্টা লাইফের বীমা গ্রাহক। উত্তর ভবানীপুর গ্রামের খোঁজ পাওয়া যায়, ভেড়ামারা উপজেলার এক বীমা কর্মীর সঙ্গে কথা বলে। বীমার ব্যবসা কেমন চলছে এ প্রসঙ্গে আলাপ হয় ওই কর্মকর্তার সাথে। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানান, ‘ধরমপুর ইউনিয়নে তারা যেতে পারে না। ওই গ্রামের কেউ বীমা কোম্পানির লোকদের বিশ্বাস করে না।’ এরপরই যাওয়ার পরিকল্পনা করা হয় ধরমপুরে। ভেড়ামারা থেকে ৬ কিলোমিটার গেলেই প্রথমেই চোখে পরে ধরমপুর ইউনিয়ন অফিস। এখানে ছোট্ট একটি বাজার।এ বাজারের ডেল্টা লাইফের গ্রাহক খুঁজতে গিয়ে কথা হয়, শিমন হোসেনের সঙ্গে। শিমন হোসেনের সঙ্গে আলাপকালে সে জানায়, ‘আমাদের গ্রামের অনেকেই বীমা করেছিল। বীমা করার প্রথম দিকে টাকা দিলেও এখন প্রতারিত হওয়ার ভয়ে আর আমরা টাকা দেই না।’ ধরমপুর বাজার থেকে শিমনই আমাদের নিয়ে যায় তার গ্রাম উত্তর ভবানীপুর। বেশির ভাগ বাড়ির লোকই কাজে গেছে। শিমন জানায়, এখন কাজের সময়। লোক বেশি পাবেন না। আমাদের অনুরোধে দু’একজনকে ডেকে আনা হয়। শিমনের বাড়ির উঠানেই কথা হয় বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে। তাদের অধিকাংশই মহিলা। কারো কারো বয়স ৬০ বছরের বেশি। শিমন হোসেন কাজ করে খান। তাই তার খুব তাড়া। বার বার বলছিলেন, বাজারে কাজ ফেলে এসেছি, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। শিমন হোসেনের বয়স ৩১ বছর। তিনি ১০ বছর আগে একটি পলিসি করেন, ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে। ৫০ হাজার টাকার ওই পলিসিতে মাসিক কিস্তি ছিল ২৮৫ টাকা। তবে শিমন কোম্পানির নাম জানেন না। কোন কোম্পানিতে বীমা করেছেন জানতে চাইলে শিমন বলেন ‘আমরা অশিক্ষিত মানুষ। লেখা পড়া জানিনে। কোম্পানির নাম বলতে পারব না। হাসেম মেকার বীমা করিয়েছিল। পরে শুনি বীমার টাকা পওয়া যায় না। তাই ২ বার টাকা দিয়ে আর টাকা দেইনি।’ শিমন পাশের একটি বাড়ি দেখিয়ে বলেন ‘ওই বাড়ির রেকেন আলী মারা গেল। কিন্তু বীমার টাকা পেল না। বউটা এখন অন্যের বাড়িতে কাজ করে। খুব অভাব। কষ্ট করে দিন চলে। অথচ বীমা কোম্পানি টাকা দিল না। এই দেখে আমি আর বীমার টাকা দেই না। তবে রেকেন কোন কোম্পানিতে বীমা করেছিল তার নাম তিনি বলতে পারেন না। রেকেনের বীমা করিয়েছিল গুল্লু। গুল্লু এখন বউ নিয়ে আমিরিকায় চলে গেছে। কোম্পানির লোকও আর আসেনি। এখন রেকেনের বউয়ের কাছে কেউ কেউ আসে। বলে টাকা পাবে। এই বলে ৫০০ এক হাজার টাকাও নিয়ে যায়। কিন্তু কেউ টাকা তুলে দিতে পারে না। মারা গেলেও যদি টাকা না পাওয়া যায় তাহলে আর টাকা জমা করে লাভ কি। তাই আমরা টাকা জমা করা বন্ধ করেছি। আমি বীমাকে বিশ্বাস করি না।শিমন পরে পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্সেও একটি পলিসি করে। কিন্তু বিশ্বাস না পেয়ে নিয়মিত কিস্তি দেয়নি। খবর পেয়ে মাঠের কাজ ফেলে ছুটে আসেন মোহন। বয়স ২৮ থেকে ৩০ বছর। মোহন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সে কিস্তি দিয়েছেন ১শ’র উপরে। প্রতি কিস্তিতে টাকা জমা দিয়েছেন ২৮৫ টাকা। ইতোমধ্যেই মেয়াদ শেষ। ডেল্টা লাইফের কর্মকর্তা হাশেম মেকার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পরে বলেছিল, আর কেউ টাকা পাক আর না পাক তুমি পাবে। এখন দু’মাস তার কোনো খবর নেই। সে পালিয়ে গেছে। মোহন ৭৫টি রশিদ আমাদের হাতে তুলে দেয়। তবে কোনো কোনো রশিদে ২/৩ কিস্তি জমা দেখানো আছে। মোহনের পলিসি নাম্বার-৫৩০০২৮১৩০-৭। গ্রামের ছোট্ট দোকানে টুকিটাকি খরচ করতে এসেছে সুরভী বেগম। তার সঙ্গে কথা হয়। সুরভী ডেল্টা লাইফে ২০০৮ সালে পলিসি করে। পর পর দুই বছর ১০ হাজার ৫০০ টাকা করে কিস্তি দেয়। এরপর কেউ তার কাছে কিস্তি নিতে আসেনি। সেও আর কিস্তি দেয়নি। একবার ডেল্টা লাইফের ভেড়ামারা অফিসে টাকা তোলার জন্য যোগযোগ করলে তাকে জানিয়েছে যে ১৫ বছর মেয়াদ পূর্ণ না হলে সে টাকা পাবে না। তবে গত কয়েক বছর গেলেও সুরভীর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। কিস্তির টাকাও নিতে আসেনি। গ্রাহকদের এমন অভিযোগের বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে আমরা যাই ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ভোড়ামারা ব্রাঞ্চ অফিসে। ভেড়ামারা থানা কার্যালয়ের অপর দিকের বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় অফিস। এখানে বসেন ব্রাঞ্চ ইনচার্জ শিরিন। তিনি বলেন, টাকা নিতে না আসার অভিযোগটি একটি ভাইরাস। মূলত, নবায়ন কমিশন কম হওয়ায় টাকা তুলতে আগ্রহী হয় না । অন্যদিকে এনজিওগুলো যেমন নির্ধারিত একটি সময়ে দল ভিত্তিক টাকা আদায় করে সেটাও আামাদের সম্ভব হয় না। এমন অবস্থায় একজন গ্রাহক থেকে অপর গ্রাহকের কাছে টাকা তুলতে না আসার কথাটি ভাইরাসের মত ছড়িয়ে যায়। ফলে কোনো গ্রাহক মনে করে কিস্তি নিতে যেহেতু আসছে না তাহলে এরা প্রতারক। এদের কোম্পানিতে টাকা জমা করা যাবে না। আবার অনেক গ্রাকহ এরমধ্যেও টাকা জমা করে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডেল্টা লাইফ অনেক পুরনো কোম্পানি। আমাদের সেবার মান ভাল। তবে এসব বিষয়ে কোম্পানির ম্যানেজমেন্টর আরো সতর্ক হওয়া উচিত।’