ব্যবসা নেই, মূলধন খেয়ে ফেলেছে নতুন ৪ জীবন বীমা কোম্পানি
ব্যবসা নেই, নবায়ন প্রিমিয়াম আয় একেবারেই নেই, অথচ ব্যবস্থাপনার সাদা হাতি পুষতে গিয়ে প্রারম্ভিক মূলধন খাওয়া শেষ, এমনটাই অবস্থা নতুন ৪ জীবন বীমা কোম্পানির।
সম্প্রতি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)র শুনানিতে কোম্পানিগুলোর তুলে ধরা তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে। প্রারম্ভিক মূলধনের ৪ কোটি টাকা শেষ করে আরও টাকা ব্যয়ের অনুমোদন চাইলে কোম্পানিগুলোকে শুনানিতে ডাকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
এ ৪টি কোম্পানি হচ্ছে প্রটেকটিভ ইসলামী লাইফ, বেস্ট লাইফ, ট্রাস্ট লাইফ, এন আরবি গ্লোবাল।
মালিকদের মুনাফালোভী মন-মানসিকতা, ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, ব্যবসায় অনিয়ম, দক্ষ জনবলের অভাব ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণনের কোম্পানিগুলোর এমন অবস্থা দাড়িয়েছে। পরিচালনা ব্যয় নামে মাত্রাতিরিক্ত খরচ, দামী গাড়ি কেনা, ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ অন্যান্যদের মোটা অংকের বেতন-ভাতা, আইন না মেনে বেশি কমিশন দেয়া সহ বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার ফলে কোম্পানিগুলোর এ অবস্থায় পড়েছে, মন্তব্য বীমা বিশেষজ্ঞদের।
ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের হার বাড়াতে ব্যর্থ হলে কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেবে, শুনানীতে এ ৪ কোম্পানিকে জানিয়ে দিয়েছে আইডিআরএ। এছাড়া পরিশোধিত মূলধন থেকে খরচ করার আর কোনো অনুমোদন দেবে না বলেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
আইডিআরএ সূত্রে জানা গেছে, প্রটেকটিভ লাইফ ২০১৩ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় দেখিয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। অথচ নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয়েছে মাত্র ৫ লাখ টাকা। বাকি ২ কোটি ২১ লাখ টাকার প্রিমিয়াম না আসায় এর অধিকাংশই ভূয়া বলে মনে করছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা।মূলত:বেতন ভাতার মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেই এ ভূয়া পলিসি দেখানো হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
এ প্রিমিয়াম আয় করতে গিয়ে কোম্পানিটি কমিশন বাবদ ব্যয় করেছে ৮৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে গাড়ি ক্রয়ে কোম্পানিটি ব্যয় করেছে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এর মধ্যে কোম্পানির চেয়ারম্যানের জন্য ৭০ লাখ টাকায় কেনা হয়েছে বিএমডাব্লিও গাড়ি, এমডির জন্য ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নিশান পেট্রোল, ডিএমডি ও এএমডিদের জন্য ২৯ লাখ টাকা দামের গাড়ি। কোম্পানিটির গাড়ি রয়েছে ১২টি।
অফিস ভাড়া বাবদ কোম্পানিটি মাসে দিচ্ছে ৬ লাখ টাকা। এছাড়া অফিস ডেকোরেশনে ব্যয় করেছে ২৯ লাখ টাকা। বিজ্ঞাপন বাবদ ব্যয় করেছে ৪৮ লাখ টাকা।
কোম্পানির ব্যয়ের খরচ মেটাতে একটি অর্থলগ্নিকারী কোম্পানি থেকে ইতোমধ্যেই সাড়ে ৪ কোটি টাকা ঋণ করেছে।
কোম্পানিতে ডিএমডি নিয়োগ দেয়া হয়েছে ৫ জন, এএমডি ১০০ জন, এসভিপি ১৫০ জন, ইভিপি ৮০জন।
ট্রাস্ট লাইফের কোনো ব্যবসাই নেই। অথচ প্রতিমাসে অফিস ভাড়া দিচ্ছে ৪ লাখ টাকা। কোম্পানিতে গাড়ি কেনা হয়েছে ৯টি। এর মধ্যে কোম্পানির চেয়ারম্যানের জন্য গাড়ি কেনা হয়েছে ৪০ লাখ টাকায়। এমডি ও ডিএমডিদের জন্য প্রতিটি গাড়ি কেনা হয়েছে ২৩ লাখ টাকায়। ব্যবসা করতে না পারলেও বেতন ভাতা, অফিসভাড়া দিয়েই প্রারম্ভিক মূলধন ৪ কোটি টাকা শেষ করে ফেলেছে কোম্পানিটি।
এনআরবি গ্লোবাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স ২০১৩ সালে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয় করেছে ২ কোটি ৯৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় হয়েছে মাত্র ৪ লাখ টাকা। কমিশন দিয়েছে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ কমিশন দেয়া হয়েছে ৯২.৬৩%।
বেষ্ট লাইফ ২০১৩ সালে প্রিমিয়াম আয় করেছে ৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। যার মধ্যে নবায়ন প্রিমিয়াম আয় করেছে ১০ লাখ টাকা। আর এ পরিমাণ প্রিমিয়াম আয় করতে গিয়ে কমিশন বাবদ খরচ করেছে ৯২%। কোম্পানিটি গাড়ি কিনেছে ২৫ টি। এ ছাড়া প্রতিমাসে অফিস ভাড়া বাবদ ব্যয় করছে সাড়ে ৭ লাখ টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, এ কোম্পানিটির সকল সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. খোরশেদ আলম। তার মদদেই রাজধানীর মতিঝিল ও মিরপুর শেওড়াপাড়া শাখায় চাকরি দেয়ার কথা বলে পলিসি করানো হয়। এসব পলিসির কোনোটিই নবায়ন হয় না। অথচ নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে পলিসি করাতে অফিস ভাড়া ও অন্যান্য খরচে ব্যয় হয় মোটা অংকের টাকা।
তবে বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক একরামুল আমিন বলেন, বীমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা নেতিবাচক। সরকার নতুন কোম্পানির অনুমোদন দিয়েছে অথচ কোম্পানি পরিচালনায় দক্ষ জনবল নেই। জীবন বীমার বাজারে এক ধরণের অস্থিরতা চলছে। এমন অবস্থায় একটি নতুন কোম্পানি দাঁড় করানো খুব সহজ নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও বিষয়টি বুঝতে হবে।
তিনি আরো বলেন, মালিকরা চায় রাতারাতি ব্যবসা বাড়াতে। অথচ তা সম্ভব নয়। মালিকদের কারণে ব্যয়বহুল অফিস নেয়া হয়। খরচ বাড়ে। অথচ দক্ষজনবল না থাকায় প্রিমিয়াম আসে না। এসব কিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কোম্পানির নবায়ন প্রিমিয়াম আয় এখন বেড়েছে। ইতোমধেই তা ৩০ লাখ টাকা হয়েছে জানুয়ারিতে তা আরো বেড়ে যাবে বলে আশা করছি।
এনআরবি গ্লোবালে চেয়াম্যান এম এম আহাদ কোম্পানির বিষয় নিয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান।
তারিখ-৩০-১২-২-১৪