নিজস্ব প্রতিবেদক: সাধারণ বীমার প্রথম সারির কোম্পানি গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধে চিঠি দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। সম্প্রতি বীমাখাতের সুনাম রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সুপারিশে আইডিআরএ'র নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধে চিঠি দেয় অর্থমন্ত্রণালয়। এছাড়া আরও বেশ কিছু কোম্পানি থেকেও সুপারিশ আসছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ ঘটনায় আইডিআরএ মনে করছে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করলে বাকি কোম্পানিগুলোর নিরীক্ষা কার্যক্রমও হুমকিতে পড়বে। এদিকে মন্ত্রণালয়ের এমন আচরণকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যক্রমের ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোতে অতিরিক্ত ব্যয় অনুসন্ধানে গ্রীন ডেল্টাসহ মোট ১৬টি প্রতিষ্ঠানে নিরীক্ষক নিয়োগ করে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এর মধ্যে প্রথম ধাপে নয়টি কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। আর বাকি ৭টি কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় দ্বিতীয় ধাপে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গ্রীণ ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কর্তৃপক্ষের সুপারিশে কোম্পানিটিতে নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধে চিঠি দিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। এছাড়া আরও বেশ কিছু কোম্পানি থেকেও সুপারিশ আসছে।
অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব মো. সাঈদ কুতুব বলেন, ১৯৫৮ সালের বিধি এখনকার জন্য প্রযোজ্য নয়। বড় কোম্পানির ব্যয় বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। গ্রীণ ডেল্টা সাধারণ বীমা খাতের সবচেয়ে বড় কোম্পানি। তাই তদের ক্ষেত্রে যে অতিরিক্ত ব্যয়ের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। তাই প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধে আমরা আইডিআরএতে চিঠি দিয়েছি।
এদিকে আইডিআরএ বলছে, সাধারণ বীমা কোম্পানির ব্যস্থাপনা ব্যয়ের ক্ষেত্রে বীমা আইন ২০১০-এর ৬৩ ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৫৮ সালের বীমা বিধির ৪৩ ধারা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। ১৯৫৮ সালের বীমাবিধির ৪০ উপধারা ১(এ)-এ সাধারণ বীমা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইডিআরএর এক সদস্য বলেন, গ্রীন ডেল্টায় নিরীক্ষক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। তবে মন্ত্রালয় থেকে এ ধরনের নির্দেশনা আসায় খাতটির বাকি কোম্পানিগুলোতেও সঠিকভাবে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে বলে আমি মনে করি না।
গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্সের কর্মকর্তারা জানান, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তব সম্মত একটি বিধি প্রণয়ন করা উচিৎ। আমাদের প্রতিষ্ঠানের আকার অনুযায়ী আমরা যে পরিমাণ ব্যয় করেছি তা অতিরিক্ত নয়। এজন্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের যেকোন ধরনের অনুসন্ধানে আমরা তাদেরকে সাহায্য করবো।
জানা গেছে, ব্যবস্থাপনা বাবদ অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে সম্প্রতি ৯ টি সাধারণ বীমা কোম্পানিতে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। কোম্পানিগুলো হলো- পিপলস ইন্স্যুরেন্স, গ্রীন ডেল্ট, এক্সপ্রেস, কন্টিনেন্টাল, ফিনিক্স, প্রগতী, ফেডারেল, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশ এবং ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স।
গ্রীন ডেল্টায় মেসার্স নুরুল ফারুক হাসান অ্যান্ড কোং, এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, কন্টিনেন্টালে মেসার্স হাওলাদার ইউনুস অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, ফিনিক্সে মসিহ মুহিত হক অ্যান্ড কোম্পানি, প্রগতীতে হুদাভাসি চৌধুরী, ফেডারেলে এমজে আবেদিন অ্যান্ড কোং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস, ইসলামী ইন্স্যুরেন্স বাংলাদেশে বিডিও এবং ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্সে এসএফ আহমেদ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিরীক্ষ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
জানা গেছে কোম্পানিগুলোর ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের বিনিয়োগ, ঋণ, অগ্রিম, স্থায়ী সম্পদ ও অন্যান্য সম্পদ, গাড়ি, জমি ও বিল্ডিং, নগদ টাকা, ট্যাক্স ও ভ্যাট, চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা কী পরিমাণ সম্মানী ও অন্যান্য সুবিধা নিয়েছেন তার পর্যালোচনাসহ কোম্পানি দুটির এই তিন বছরের আয়, ব্যয় ও সম্পদের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কোম্পানি।
জানা যায়, বীমা আইন ২০১০’র ২৯ ধরার ক্ষমতা বলে কোম্পানিগুলোতে এ নিরীক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ২ মাসের মধ্যে তাদের নিরীক্ষা প্রতিবেদন আইডিআরএ’র কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত বীমা আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে- আইনের অন্য কোন বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন, কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশে বীমা ব্যবসা পরিচালনাকারী যে কোন বা সকল বীমা কোম্পানির বীমা সংক্রান্ত সকল লেনদেন, রেকর্ডপত্র, দলিল দস্তাবেজ, সময় সময়, প্রবিধান দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে এক বা একাধিক নিরীক্ষক দ্বারা নিরীক্ষা করাতে পারবে।
ধারায় আরো বলা হয়েছে, এই ধারার অধীনে নিযুক্ত নিরীক্ষক বীমাকারীর বীমা ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র, হিসাব বই, রেজিস্টার, ভাউচার, পত্রাদি এবং অন্য সকল দলিলাদি পরিদর্শন করতে পারিবে এবং এ উদ্দেশ্যে বীমাকারীর যে কোন পরিচালক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বক্তব্য শ্রবণ করিতে এবং বীমাকারীর নিকট থেকে যে কোন প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র ও তথ্যাদি তলব করতে পারবে।
আইডিআরএ সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি সাধারণ বীমা কোম্পানিগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৭ বছরে দেশে ব্যবসা করা ৪৩টি সাধারণ বীমা কোম্পানি আইন লঙ্ঘন করে ১ হাজার ৪৫২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করায় কোম্পানির আর্থিক অবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন শেয়ারহোল্ডাররা। তারা তাদের প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন। পাশাপাশি গ্রাহকদের বীমা দাবির টাকা পরিশোধেও কোম্পানির সক্ষমতা কমে যেতে পারে।