জীবন বীমা প্রস্তাবপত্র পূরণ করার নিয়ম

কল্যাণ চক্রবর্তী:

জীবন বীমা , প্রস্তাবপত্রের উপর ভিত্তি করে বীমা চুক্তি গঠিত হয়। এর প্রত্যকটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। কোন একটি উত্তর অসামঞ্জস্য হলে বীমা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় না। পুনরায় অসামঞ্জস্যতা মাফিক চাহিদা পত্র দেওয়া হয় । অন্যদিকে একজন বীমা প্রতিনিধির এই প্রস্তাবপত্র হচ্ছে দীর্ঘ দিনের, দীর্ঘ প্রতীক্ষার একটি ফসল। তাই কোন ক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত না হলে, সে কষ্টের শেষ থাকে না। ফলে জীবন বীমার প্রস্তাব পত্রটি খুব সাবধানতার সহিত বীমা গ্রাহীতার সামনে বসে প্রত্যেক প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে পূরণ করতে হয়। তড়িঘড়ি করে বীমা চুক্তি পূরণ করার জন্য এখানে কোন মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করা ঠিক নয় । ভবিষ্যতে যে কোন দাবী পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রস্তাব পত্রের লিপিবদ্ধ প্রত্যকটি তথ্য সম্পর্কে তদন্ত হতে পারে। তাই এখানে কোন ক্রমেই মিথ্যা বর্ণনা লিপি বদ্ধ করা যায় না। মনে রাখরেন জীবন বীমা একটি চরম সদ্বিশ্বাসের চুক্তি । কোন পক্ষকে এক্ষেত্রে বিশ্বাস ভঙ্গ করা যাবে না। করলে বীমা চুক্তি বাতিলযোগ্য হবে।

প্রস্তাবপত্রের যে সকল বিষয়গুলি যত্নেমর সহিত পুরণ করতে হবে:

১) বীমা গ্রাহকের পূর্ণ নাম বাংলা ও ইংরেজিতে: আমার বাস্তব অভিজ্ঞায় বলছি শতকরা ৮০ ভাগ প্রস্তাবপত্র শুধু এই নাম ভুল করার কারণে এফপিআর করা যায় না। বীমা গ্রহীতা নাম স্বাক্ষর করলেন “মুজিবশেখ” কিন্তু তার নাম ও তার পিতার নামের বানান ঠিক না থাকলে প্রস্তাবটি প্রস্তাবকের ঘোষণা ছাড়া গ্রহণ করা যায় না। অধিকাংশে বীমা গ্রহীতার নাম ও পিতার নাম ভোটার তালিকা ও অন্যান্য প্রমাণপত্রে গরমিল থাকে। সে ক্ষেত্রে বয়সের প্রমাণপত্রের গরমিলের একটি সঠিক ঘোষণাসহ প্রস্তাবটি দাখিল করতে হবে। মোট কথা বয়সের প্রমাণপত্রের সহিত বীমা গ্রহীতার ও পিতার নামের বানান লক্ষ্য রেখে প্রস্তাবপত্র পুরণ করতে হবে। এবং যে গরমিল লক্ষ্য করা যায় সেক্ষেত্রে বীমা গ্রাহীতার সঠিক ঘোষণা অনুযায়ী লিখতে হবে।

২) পেশা: এই বিষটি যথেষ্ট যত্নসহকারে দেখা হয়। অনেক সময় চাকুরী হলে শুধু চাকুরী এবং ব্যবসা হলে শুধূমাত্র ব্যবসা লিখে রাখা ঠিক নয়। এখানে চাকুরী হলে, কী চাকুরী করেন, কাজের ধরন কি, তার বিস্তারিত বিবরণ লিখতে হবে। ব্যবসা হলে কিসের ব্যবসা করেন তার বিস্তারিত বিবরণ লিখতে হবে, বুঝাতে না পরলে পেশাগত প্রশ্নমালা ফরম পুরণ করে নিতে হবে। অর্থাৎ যিনি নিয়োগপ্রত্র স্বাক্ষর করেছেন সেই কর্মকর্তার নাম লিখতে হবে।

৩) শিক্ষার মান: বীমা প্রস্তাবের এই বিষয়টি খুব জটিল এবং স্পর্শকাতর । অনেক সময় এর সঠিক উত্তর বের করতে গিয়ে পলিসি করানো সম্ভব্য হয় না বিধায় কোন বীমা গ্রাহককে সরাসরি প্রশ্ন করা ঠিক নয় যে, আপনার শিক্ষার মান কি? আবার এখানে মিথ্যা কথা ও লেখা ঠিক নয় । বীমা গ্রাহকের শিক্ষার মান জানা না থাকলে, তাকে মিস্টি করে বলবেন আপনার বয়সটা প্রমাণ করবেন কি দিয়ে? আমরা সাধারণত এসএসসি পাশের সার্টিফিকেট, ভোটার তালিকা, ন্যাশনাল আইডি কার্ড, বিয়ের কাবিননামা ও পাসপোর্ট নিয়ে বয়স প্রমাণ করে থাকি। একপর্যায়ে বলবেন এসএসসি বা সমমানের সার্টিফিকেট এর গুরুত্ব বেশি দেয়া হয়, কেননা এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সঠিক। দেখবেন তার শিক্ষার মান কি, এই আলাপের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসবে।

৪) স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম, ডাকঘর, থানা ও জেলাসহ স্থায়ী ঠিকানা ঠিক মত লিখতে হবে। যথেষ্ট যত্নসহকারে বীমা গ্রাহকের বর্তমান ঠিকানা বা যোগাযোগের ঠিকানা লিখতে হবে। জীবন বীমা একটি দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি। বীমা গ্রহকের সহিত ২০ বৎসর ধরে তার যোগাযোগ করতে গিয়ে উক্ত ঠিকানায় চিঠিপত্র পাঠাতে হবে বিধায় ডাক পিয়নকে চিনতে, বুঝতে বা পেতে কষ্ট না হয় এমনভাবে যোগাযোগের ঠিকানাটি লেখা অবশ্যক। বর্তমানে পোস্ট কোড নম্বরটি লিখতে হবে। বীমা গ্রাহক যে জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন, জন্মস্থান ঘরে সে জেলার নাম লিখতে হবে।

৫) পরিকল্পের নাম, নম্বর, মেয়াদ বীমা অঙ্ক, প্রিমিয়াম প্রদান পদ্ধতি এবং সহযোগী বীমার কলামটি পুরণ করতে অনেকেই ভুল করেন এবং কাটাকাটি করা থাকে। মনে রাখা প্রয়োজন এসব ক্ষেত্রে কোন রকম কাটাকাটি গ্রহণ করা হয় না। কোন কারণে যদি কাটাকাটি হয়ে যায় তবে বীমা গ্রহীতার নিকট থেকে এ মর্মে একটি ঘোষণা রাখতে হবে। আরো মনো রাখা দরকার, বীমা প্রস্তাবপত্রে কাটাকটি, সংশোধন ও সংযোজনের অধিকার একমাত্র প্রস্তাবকের, অন্য কারো নয়। ফলে খুব যত্নসহকারে কোন রকম কাটাকাটি বা ঘষা মাজা ছাড়া এই ঘরগুলো পুরণ করতে হবে।

৫) মনোনীতকের নাম: এ কলামটি বীমা চুক্তির একটি উল্লেখযোগ্য দিক। পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে জীবন বীমায় কারা নমিনি হওয়ার যোগ্য। তবুও পুনরায় লিখলাম, জীবন বীমা প্রস্তাবে স্ত্রীর নমিনি হওয়ার অধিকার প্রথম, অন্য দিকে স্ত্রীর পলিসিতে স্বামীর অধিকার প্রথম। এছাড়া অনেকে একটি বিষয় অহরহ ভুল করেন তা হলো, প্রস্তাবকের ছেলেমেয়ের সংখ্যা ৩/৪ জন অথচ নমিনি করেন একজন সন্তানকে এটা সাধারণত গ্রহণ করা হয় না। জীবন বীমা একটি সম্পত্তি, পিতা মারা গেলে তার সমস্ত ছেলে মেয়েরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নমিনি হওয়ার অধিকার সবার। সন্তানদের নমিনি করলে সবাইকে করতে হবে, নতুবা স্ত্রীকে নমিনি করতে হবে। সন্তানদের নমিনি করলে তাদের মাকে অভিভাবক নির্বাচন করতে হবে। অনেকে যুক্তি দেখান আমি যাকে খুশি নমিনি করবো, বীমা কোম্পানীর কি? মনে রাখবেন জীবন বীমার নমিনেশন আবেগের ব্যাপার নয়, এটা অধিকার ও নীতির ব্যাপার। স্ত্রীর, ছেলে/ মেয়ে না থাকলে পিতা বা মাতা নমিনি হতে পারে। এরা না থাকলে বড় ভাই বা বীমা গ্রহীতার উপর নির্ভরশীল ছোট ভাই নমিনি হতে পারে। বোনরা জীবন বীমার নমিনি হতে পারে না। তাই উল্লেখিত নিয়ম মাফিক মনোনীতক নিয়োগ করলে প্রস্তাবটি গ্রহণে কোন জটিলতা থাকে না।

৬) অপশন (Option): এই প্রশ্নটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বীমা গ্রহীতাকে এর গুরুত্ব বুঝিয়ে উক্ত স্থানে ++ চিহ্ন দিতে হবে। ইহা একটি বীমা তামাদি না হওয়া আধুনিক ব্যবস্থা।

৭) পূর্ববর্তী বীমা আছে কিনা: এই প্রশ্নটি সচরাচর লুকিয়ে আর একটি বীমার প্রস্তাব করা হয়, এটা কোন রকমই ঠিক নয়। কেননা পূর্ব পলিসির কথা উল্লেখ না করলে, পরবর্তীতে প্রকাশ পেলে কোনটির দাবী পরিশোধ করা যাবে না। ফলে পূর্ববর্তী বীমা আছে কিনা? থাকলে প্রস্তাবের এই ঘরটি যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে।

৮) প্রস্তাব পত্রে একটি উত্তর জানতে চাওয়া হয়। তাহলো, আপনার জীবনের প্রতিকূল প্রভাবকারী কোন তথ্য আছে কি? এক্ষেত্রে আমাদের কর্মীরা গতানুগতিকভাবে (না) এর ঘরে (Ö) চিহ্ন দিয়ে দেন। কিন্তু এই উত্তরটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কেননা একজন ব্যক্তি যে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে অপরাধী, বিভিন্ন অপরাধ কর্মের সহিত সে জড়িত, সেখানে সর্বক্ষণ তার মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে। অথবা এমন কোন কর্মকাণ্ডে সে জড়িত যে, আততায়ীর হাতে যে কোন সময় তার মৃত্যু হতে পারে। এরূপ বীমা গ্রহীতাদের বেলায়, এক্ষেত্রে Ö চিহ্ন দেওয়া ঠিক নয়। পরবর্তীতে সত্য তথ্য উদঘাটিত হলে বীমার মৃত্যু দাবী পরিশোধ করা হয় না। তবে (হ্যাঁ) ঘরে (Ö)  চিহ্ন দিলেই যে, বীমা গ্রহণ করা হবে না এমন নয়। ঐসব বীমা গ্রহীতাদের নিকট হতে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিয়ে বা লিয়েন দিয়ে বীমা দেওয়া যায়।

৯) মহিলা প্রশ্নমালা: মহিলাদের জীবন সর্বদা ঝুঁকিপূর্ণ তাই এ প্রশ্নগুলির সঠিক উত্তর দিতে হবে এবং এখানে কোন ঘষামাজা বা কাটাকাটি গ্রহণযোগ্য হবে না।

ডাক্তারী পরীক্ষাবিহীন জীবন বীমার জন্য প্রস্তাবকের অতিরিক্ত বিবৃতি (Non-medical Deceleration form) সংক্ষেপে (NMDF)  

জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানে যারা অবলিখন বিভাগে আছেন তারা এ ফরমটি অত্যাধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন। এখানে যতগুলি প্রশ্ন রয়েছে তা বীমা গ্রহীতাকে পড়ে শুনিয়ে (Ö) চিহ্ন দিতে হবে। গতানুগতিক (Ö)চিহ্ন কখনো দেওয়া উচিত নয়। এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন রয়েছে যা বীমা গ্রহীতাকে করা হয়, আপনি কি সুস্থ হ্যাঁ / না। দেখা যায় দুটিতেই ঠিক (Ö) চিহ্ন দেওয়া থাকে। এ বিষয়টি নিয়ে প্রায় যুক্তি দেখানো হয়, এটা ভুলবশত হয়ে গেছে। অবলিখন বিভাগে যারা আছেন তাদের কোন রকম ক্ষমতা নেই, এই বিষয়টি হালকা করে দেখার। সুতরাং যত্নসহকারে পড়ে বীমা গ্রহীতার সামনে এটা পূরণ করতে হবে। এছাড়া NMDF-এ আরো যে সকল প্রশ্ন আছে তার সঠিক উত্তর দিতে হবে। কোন প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ এর ঘরে (Ö) চিহ্ন পড়লে গ্রহণ করা হবে না বা বীমা চুক্তি হবে না এইরূপ ধারণা ঠিক নয়। আমার দশ বৎসর অবলিখনের অভিজ্ঞতায়, হাতে গোনা কয়েকটি প্রস্তাব বয়সজনিত বা দূরারোগ্য ব্যাধির  কারণে বাতিল হয়েছে, অন্য কোন কারণে নয়। শারীরিক পরিমাপ ও পারিবারিক ইতিহাসটি যত্নসহকারে পূরণ করতে হবে, এখানে ঘষামাজা বা কাটাকাটি গ্রহণ করা যায় না। এই ক্ষেত্রে আরো যে বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় তা হলো (NMDF) - এ তারিখ ছাড়া বীমা গ্রাহকের স্বাক্ষর রাখা হয়। এক মাস বা আরো পরে অফিসে এসে তারিখ বসানো হয়। এক্ষেত্রে অবলিখকগণ স্বাক্ষর ও তারিখ দেখে সহজেই কালির পার্থক্য বুঝতে পারেন এবং ফাইল ছাড়তে পারেন না তাই স্বাক্ষরের সাথে সাথে একই কলম দিয়ে একই দিনে  (NMDF)- এর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এবং তারিখ বসাতে হবে। এবিষয়টি সর্বদা মনে রাখা প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে আর একটি বিষয়ে বেশি নজর রাখতে হবে তা হলো পারিবারিক ইতিহাস। বেশির ভাগ বীমা গ্রাহক তার বাবা মায়ের বয়স ও মৃত্যুর সন উল্টো পাল্টা বলেন। এগুলি নোট করে ভিন্ন সাদা কাগজে মিলিয়ে দেখে পরে (NMDF) - এ লেখা উচিত, নচেৎ কাটাকাটি পরিহার করা যাবে না। পিতামাতা বা বীমা গ্রহীতার যত ছোট বয়সে আদরের বিয়ে হোক না কেন, মেয়েদের ২২ বৎসর এবং ছেলেদের ২৫ বৎসরের পূর্বে সন্তানের জনক জননী হওয়াটা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং এই দিকটা খেয়াল রাখতে হবে।

লেখক: সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে কোম্পানি লিমিটেড’র এডিশনাল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর অ্যান্ড সিএফও।