নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের অন্যতম আর্থিক উপখাত বীমা শিল্পে বিগত বছরটিতে ঘটেছে নানান ঘটনা। জন্ম দিয়েছে বেশ কিছু আলোচিত সংবাদের। ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’র বিবেচনায় ২০১৬ সালে বীমাখাতে ঘটে যাওয়া আলোচিত ১০টি ঘটনা ।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ৬ কোম্পানির অনিয়মের চিত্র: বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) কর্তৃক নিয়োগ দেয়া নিরীক্ষক ৬টি বীমা কোম্পানি প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স, মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্স ও জীবন বীমা কর্পোরেশন এর ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালের আয়-ব্যয়ের ওপর নিরীক্ষা (অডিট) কার্যক্রম শুরু করে। বীমা কোম্পানিগুলোর ৩ বছরের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রতিবেদন আইডিআরএ জমা দেয়। এসব প্রতিবেদনে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে শত শত কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরা হয়। বীমা কোম্পানিগুলোর জমা দেয়া ২০১৫ সালের আর্থিক প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ২৭ আগস্ট ওই ৬ কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ।
১৭ লাইফ বীমা কোম্পানিতে দুদকের অনুসন্ধান: অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে গ্রাহকদের ১৭৮১ কোটি টাকা খেয়ে ফেলার অভিযোগে ১৭টি লাইফ বীমা কোম্পানিতে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) । প্রথম দফায় ৬ কোম্পানি, আইডিআরএ এবং অডিট ফার্মের কাছে রেকর্ডপত্র চায় দুদক।
১৮ জুন ২০১৬ তারিখে বীমাখাতের একমাত্র অনলাইন নিউজ পোর্টাল ইন্স্যুরেন্সনিউজবিডি’তে ‘গ্রাহকদের ১৭৮১ কোটি টাকা খেয়ে ফেলেছে ১৭ লাইফ বীমা কোম্পানি’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
বীমা কোম্পানির ৩ মূখ্য নির্বাহীর কারাবাস: বিভাগীয় কর্মকর্তা ও গ্রাহক হয়রানির মামলায় গত ১৯ ডিসেম্বর কারাবন্দি হন বেসরকারি লাইফ বীমা কোম্পানির ৩ মূখ্য নির্বাহীসহ ৫ কর্মকর্তা। পরদিন আপোষের শর্তসাপেক্ষে তাদের জামিন দেন কুমিল্লা জেলা দায়রা জজ আদালত। রূপালী লাইফের স্থানীয় বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. সারোয়ার আলম পাঠান বাদি হয়ে এই মামলা করেন।
রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. গোলাম কিবরিয়া, গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী নূর মোহাম্মদ ভূঁইয়া,যমুনা লাইফের মূখ্য নির্বাহী বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল। সহ রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ২ কর্মকর্তা নজরুল ও প্রদীপ এর বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়। নূর মোহাম্মদ ভূঁইয়া এরআগে রূপালী লাইফের সিইও হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের সিএফও।
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান:
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) । এ লক্ষ্যে দুদকের এক উপ-পরিচালককে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।
অভিযোগ হচ্ছে, বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান হয়েও অন্তত ১৫টি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার বেচাকেনা করেছেন শেফাক আহমেদ। দিলকুশায় নতুন ভবনে ওঠার জন্য ১০ কোটি টাকা গচ্চা, বছরের পর বছর বেতনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ গাড়ি ভাড়া গ্রহণ, ব্যক্তিগত ১৮টি মামলার খরচ বাবদ আইডিআরএ’র কোষাগার থেকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ৩০ লাখ টাকার ওপরে ব্যয়, অবৈধ লেনদেনের বিনিময়ে বিভিন্ন বীমা প্রতিষ্ঠানে অযোগ্য ব্যক্তিদের সিইও নিয়োগ অনুমোদন, নতুন বীমা প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদানে অবৈধভাবে মোটা অংকের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের লাইসেন্স ফেরত: পুনর্বীমা সংক্রান্ত অনিয়মের কারণে স্থগিত লাইসেন্স ফিরে পায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমাখাতের কোম্পানি স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড। গত অক্টোবর ১৮ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি বীমা আইডিআরএ ও কোম্পানিকে পাঠানো হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর আইডিআরএ কোম্পানিটির লাইসেন্স স্থগিত করে। এরপর কোম্পানিটি হাইকোর্টে গেলেও লাইসেন্স স্থগিতই থেকে যায়।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম গঠন: চলতি বছরের শুরুতে বীমা কোম্পানিগুলোর মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম (বিআইএফ) গঠন করে। এ বছরেই রেজিস্ট্রারার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এন্ড ফার্মস-এ নিবন্ধিত হয় সংগঠনটি।। বাণিজ্য সংগঠন নীতিমালা অনুসারে এ বছরেই অনুমোদিত হয় বিআইএফ।
বিআইএ থেকে মূখ্য নির্বাহীদের পদত্যাগ: বীমা কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইএ) থেকে পদত্যাগ করে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারা। গত ৫ মে বীমা কোম্পানির মূখ্য নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের (বিআইএফ) এক সভায় মূখ্য নির্বাহীরা বিআইএ থেকে পদত্যাগের বিষয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে কোম্পানির পক্ষ থেকেও ওই সংগঠনে প্রতিনিধিত্ব না করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। এর আগ পর্যন্ত বীমা কোম্পানিগুলোর মূখ্য নির্বাহি কর্মকর্তারাও বিআইএ’র সদস্য ছিল।
ফারইষ্টের মূখ্য নির্বাহীর সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক: ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হেমায়েত উল্লাহ অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন কিনা তা জানতে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) । রাজধানীর ধানমন্ডি, বসুন্ধরা, উত্তরা, বনশ্রী, বাসাবো, মেরাদিয়া, খিলগাও ও মলিবাগে একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ির মালিক। এছাড়া ধানমন্ডিতে একটি প্যাকেজিং কারখানাসহ গাজিপুর বোর্ডবাজার, গাইবান্ধা, নোয়াখালির একাধিক কারখানার মালিক হেমায়েত উল্লাহ। অবৈধভাবে এসব সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থাকায় দুদক তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে।
নন-লাইফে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের গেজেট প্রকাশ, পরে প্রত্যাহার: গত ১৮ জুলাই ‘নন-লাইফ ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণী প্রবিধানমালা- ২০১৬’ নামে গেজেট প্রকাশ করে আইডিআরএ। এতে ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সীমা ১৯৫৮ সালের বিধিমালায় নির্ধারিত সীমার চেয়ে আরো ৯ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়।
এরপরই এ ধরণের অবাস্তব প্রবিধানমালা করায় বীমাখাতে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ অবস্থায় আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম শেফাক আহমেদ একচ্যুয়ারি প্রবিধানের গেজেটটিতে ভুল হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, চূড়ান্ত গেজেট নোটিফিকেশনে আমাদের প্রস্তাব ভুলবশত পরিবর্তিত হয়েছে। এ কারণে ব্যবস্থাপনা ব্যয় সংক্রান্ত নতুন বিধি বাস্তবায়ন করা হবে না বলে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
নিরীক্ষক নিয়োগ: বেসরকারি খাতের ১৬টি ননলাইফ ও ৬টি লাইফ বীমা কোম্পানিতে নিরীক্ষক নিয়োগ করে আইডিআরএ। এর মধ্যে প্রথম দফায় ৬টি লাইফ বীমা কোম্পানি। দ্বিতীয় দফারয় ৮টি ননলাইফ ও তৃতীয় দফায় আরো ৮টি ননলাইফ বীমা কোম্পানিতে নিরিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। বীমা আইন ২০১০ এর ২৯ ধারা অনুসারে এসব কোম্পানিতে বিশেষ নিরিক্ষক নিয়োগ করা হয়।