যে মামলায় কারাগারে গেলেন ৩ মূখ্য নির্বাহী

নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘গ্রাহকরা আমাকে বিশ্বাস করে রুপালী লাইফে পলিসি করেছিল, কোম্পানিকে দেখে নয়। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রতারণার হাত থেকে এসব গ্রাহককে রক্ষার দায়িত্ব আমার এবং আমি এ দায়িত্ব নিয়েছিও। আর এ কারণেই গত ৪ বছর ধরে আইনী লড়াই করে আসছি।’ ইন্স্যুরেন্স নিউজবিডি.কম এর কাছে এভাবেই ব্যাখা করছিলেন সম্প্রতি লাইফ ইন্সুরেন্সের ৩ মূখ্য নির্বাহীর কুমিল্লার কারাগারে প্রেরণ সংক্রান্ত আলোচিত মামলার বাদী মো. ছারোয়ার আলম পাঠান।

গত ২০ জুন কুমিল্লার আদালত চত্বরে ছারোয়ার পাঠান ইন্স্যুরেন্স নিউজবিডি.কম কে আরো বলেন,‘আজ ৪ বছর পর সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আত্মবিশ্বাস আরো বেড়েছে। আমার প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ফিরে এসেছে। এটাই অনেক পাওয়া। তবে আশঙ্কা কিছুটা রয়ে গেছে। যাদের বিরুদ্ধে লড়ছি তারা সমাজের প্রভাবশালী-প্রতাপশালী ক্ষমতাধর। সবচেয়ে বড় কথা তারা টাকাওয়ালা। তাতে কি? আমি কিন্তু হালছাড়ার পাত্র নই, শেষ পর্যন্ত লড়াইটা করে যেতে চাই। জানি সত্যের জয় হবেই।’ গত ২০ জুন সারা দেশের বীমা পেশাজীবিদের নজর ছিল কুমিল্লার আদালতের দিকে। লাইফ ইন্সুরেন্সের ৩ মুখ্য নির্বাহীসহ ৫ কর্মকর্তা জামিনের সিদ্ধান্ত হবে আদালতে। তাদের জামিন হলো-কি-হলো না, তা নিয়ে গোটা বীমা খাতেই ছিল চাপা উত্তেজনা। ৩টি কোম্পানির উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় বীমা কর্মকর্তাদের ভীড় ছিল কুমিল্লার আদালতে।

ছারোয়ার পাঠানও তার আইনজীবিদের সঙ্গে নিয়ে ছিলেন আদালতে। জেলা দায়রা জজ আদালতের লাল ভবনটির দোতালায়। দুপর ২ টার দিকে শুনানী শেষে বিচারক গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়ার শর্তে জামিন মঞ্জুর করেন। আসামীদের পক্ষে ১৬ জন আইনজীবি আদালতে শুনানী করেন।

জানা গেছে, ছরোয়ার আলম পাঠান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ার কলেজ থেকে পরিসংখ্যানে অনার্স শেষ করার পর বীমা পেশা শুরু করেন। ২০০৭ সালে তিনি রূপালী লাইফের সঞ্চয় বীমা প্রকল্পে ডেপুটি ডিরেক্টর পদে কুমিল্লার বিভাগীয় কার্যালয়ে যোগদান করেন। বিভাগীয় অফিস থেকে তিনি ৬টি অফিস পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি রূপালী লাইফে ২০০০ গ্রাহককে পলিসি করান। কোম্পানিও তাকে ৪ বার পদোন্নতি দেন। কিন্তু বিপত্তিটি ঘটে ২০১২ সালের মে মাসে। এ সময় গণমাধ্যমে বেশ কিছু এমএলএম প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মাসাতের অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এতে গ্রাহকদের মাঝে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। তবে ছারোয়ার টাকা জমা সংক্রান্ত নথি-পত্র উপস্থাপন করে গ্রাহকদের আশ^স্ত করেন।

কিন্তু বীমা গ্রাহক রনি বাবুর মৃত্যুর পর পরিস্থিতি পালটে যায়। রনি বাবুর স্ত্রী সুমি বেগম মৃত্যু দাবি আদায়ে প্রধান কার্যালয়ে গেলে ফাঁস হয়ে পড়ে অপকির্তি। দেখা যায়, ছারোয়ার গ্রাহকদের টাকা কোম্পানিতে জমা করলেও এন্ট্রি দেয়া হয়নি প্রধান কার্যালয়ের কম্পিউটারের ডাটা বেজে। গ্রাহকদের টাকা জমা করতে ছারোয়ার পাঠান বারবার ছুটে যান প্রধান কার্যালয়ে। তাতে কোনো লাভ হয় না। টাকা জমা করা তো দুরের কথা প্রধান কার্যালয় থেকে বের করে দেয়া হয় ছারোয়ারকে। অন্যদিকে গ্রাহকদের জানিয়ে দেয়া হয় ডাটা বেজে কোনো টাকা জমার এন্ট্রি নেই। প্রধান কার্যালয়ে কর্মকর্তারা টাকা আত্মসাতের অভিযোগটি তোলেন ছারোয়ারের দিকে। এতে ছারোয়ারের প্রতি গ্রাহকদের অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করে। গ্রাহকরা ভিড় করেন কুমিল্লার আঞ্চলিক কার্যালয়ে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গ্রাহকদের মাঝে। গ্রাহকরা টাকা আত্মাসাতের অভিযোগ এনে ছারোয়ারে বিরুদ্ধে জিডি করেন। জিডির তদন্ত কর্মকর্তাকে ছারোয়ার সকল নথিপত্র উপস্থাপন করেন। এতে সন্তোষ্ট হন তিনি। নথিপত্র যাচাই করে তিনিই ছারোয়ারকে পরামর্শ দেন আইনের আশ্রয় নিতে। ছরোয়ারের বিরুদ্ধে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় জিডি করেন বীমা গ্রাহক রিফাত হোসেন পলিসি নং-২০৬১০০০৫৩-৭ ও সেলিনা পারভীন পলিসি নং-২০৬১০০০৭৬-০। পরবর্তীতে তারাই ছারোয়ারের পক্ষে মামলার সাক্ষি দেন। গ্রাহকরা থানায় জিডি করার পর বিষয়টি মিমাংসা করার জন্য ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল প্রধান কার্যালয়ে যান ছারোয়ার। সকল নথিপত্রই প্রধান কার্যালয়ে দাখিল করেন তিনি। তখনকার কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী নূর মোহাম্মাদ ভূইয়া, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশ^জিৎ কুমার মন্ডল, মো. গোলাম কিবরিয়া, সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম, প্রদীপ সূত্রধর সকলকেই গ্রাহকদের অভিযোগ সম্পর্কে জানান। কিন্তু তারা টাকা জমা করার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ছারোয়ারকে অফিস থেকে বের করে দেন। পরে ছারোয়ার ২০১৩ সালে ৫ মে প্রধান কার্যালয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উকিল নোটিশ করেন। ওই নোটিশে গ্রাহকের টাকা কম্পিউটারের ডাটা বেজে এন্ট্রি করাসহ গ্রাহকদের হয়রানি বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ৭ দিন সময় বেঁধে দেন। কিন্তুু প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের দফতরেও দাখিল করা হয় উকিল নোটিশের অনুলিপি। এরও পরে ২০১৩ সালের ১১ জুন ছারোয়ার আদালতে মামলা করেন। অর্থ আত্মসাতের এ মামলার প্রধান আসামী রূপালী লাইফের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুর মোহাম্মদ ভূঁইয়া (বর্তমানে গোল্ডেন লাইফ ইন্স্যূরেন্সের মূখ্য নির্বাহী), উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ ও হিসাব) বিশ^জিৎ কুমার মন্ডল (বর্তমানে যমুনা লাইফের মূখ্য নির্বাহী), উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (প্রশাসন ও সংস্থাপন) গোলাম কিবরিয়া(বর্তমানে রুপালী লাইফের মূখ্য নির্বাহী), সিনিয়র নির্বাহী কর্মকর্তা (অর্থ ও হিসাব) মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও প্রদীপ চন্দ্র সূত্র ধর। মামলার এজাহারে আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রাহকের জমা করা প্রিমিয়াম, বেতন-ভাতা, কমিশন, কার্যালয়ের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, টিএ ডিএ বিল ও দাফতরিক খরচ বাবদ ১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন ছারোয়ার। মামলার খরচ যোগাতে ভুক্তভোগী ছরোয়ার পাঠান ভোলার পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে দেন। তাতেও খরচ কুলায় না। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে পাশে দাড়ান তার শ্বশুর। ছরোয়ার ইতোমধ্যেই বেকার। বেতন-ভাতা বা কমিশনসহ কোম্পানি থেকে কোনো টাকা পয়সা পায়নি ২০১০ সাল থেকে। অন্যদিকে গ্রাহকদের চাপ। সংসারের খরচ। ধার-কর্জ করেই দিন কাটে তার। মামলার করে আবার অপেক্ষার পালা। আদালত মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন অফিসার ইনচার্জ কোতোয়ালি থানাকে। এতে তদন্তের দায়িত্ব পান কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আইয়ুব আলী। পরে আইয়ুব আলী বদলি হয়ে গেলে পরবর্তীতে মামলাটি তদন্ত করেন পুলিশ পরিদর্শক মো. সামসুজ্জামান। সামসুজ্জামান তদন্ত করে প্রতিবেদন দেন ২০১৫ সালের ২২ জুন। অর্থাৎ মামলার করার ২ বছর পর। এ প্রতিবেদনে আসামীদের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বা যায় নি এ ধরনের কোনো বক্তব্য আনা হয় না। এতে ছারোয়ার ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দাখিল করেন। আদালত নারাজির আবেদন মঞ্জুর করে গত ৬ অক্টোবর ২০১৫ সালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেন। পিবিআই পুলিশ পরিদর্শক (নিঃ) মো. মঞ্জুর কাদের ভূঁইয়াকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। পিবিআই এক বছর তদন্ত করে গত ১০ অক্টোবর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ প্রতিবেদনটিতে প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়। প্রতিবেদনের উপর ৬ অক্টোবর আদালত শুনানী শেষ করেন। ৯ তারিখে আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। পরে আসামীরা উচ্চ আদালত থেকে ২২ নভেম্বর ৪ সপ্তাহে অন্তবর্তীকালিন জামিন নেন। ১৯ অক্টোবর কুমিল্লার আদালতে হাজির হলে আমলী আদালত ৩ মূখ্য নির্বাহীসহ ৫ বীমা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। গত ২২ তারিখ বৃহষ্পতিবার আবারো হাজিরা দেন আসামীরা। ছারোয়ার বলেন, আমি ন্যয় বিচার চাই। গ্রাহকের টাকা কোনোভাবেই যেন কেউ আত্মসাৎ করতে না পারে, সে বিষয়ে সকলেরই আরো সচেতন হতে হবে। আদালত আপোষের শর্তে জামিন দিয়েছেন। আসামীরা আপোষ করবে কি না, তা তাদের বিষয়। তবে আপোষের বিষয়ে এখনও কেউ যোগাযোগ করেন নি বলে জানিয়েছেন ছারোয়ার।