কল্যাণ চক্রবর্তী:
একজন বিপণন কর্মীর দৈনন্দিন কার্যাবলীর মধ্যে নিয়মিত ডাইরি লেখা একান্ত কর্তব্য। সারা দিনের কাজের বিবরণী রাত্রে ঘুমানোর পূর্বে ডায়েরিতে লিখে রাখতে হবে। এ সাথে আগামী দিনের কি কি কার্যসূচী তাও ঐ রাত্রে লিখে রাখতে হবে এবং পরদিন সকাল থেকে সে মোতাবেক কাজ বের হতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন একজন সম্ভাব্য ক্রেতার সহিত নির্ধারিত সময়ে অবশ্যই সাক্ষাৎ করতে যেতে হবে, তার সাথে আগেও নয় পরে ও নয় । সম্ভাব্য ক্রেতা যদি দেখেন আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন তবে আপনার প্রতি তিনি সদয় থাকবেন। কেননা এই যান্ত্রিক যুগে মানুষের এক মিনিট সময়ের দামও প্রচুর। আর এই জন্য একজন বিপণন কর্মীকে ডায়েরি লেখা ছাড়া কোন ক্রমে চলা ঠিক নয়। একদিন ১০ জনের সাথে সাক্ষাৎ করার কথা থাকলে ৪ জনের সাথে আপনার দেথা নাও হতে পারে। এতে আপনার দুঃশ্চিন্তা বা বিরক্তির কিছু নেই। কেননা “Client can do no wrong” ভাবী ক্রেতার কোন ভুল নেই।
আপনি যে চার জনের সহিত আলাপ করতে পারবেন না । ঐ সময় একাগ্র চিত্তে নতুন Client এর সন্ধান করতে থাকুন। যারা জীবন বীমা পেশায় সাফল্য লাভ করেছে তাদের ইতিহাস পড়ে জানা গেছে, তারা তাদের প্রত্যহ সাক্ষাৎকারের সংখ্যা কোন মাসে কমতে দেননি। আর এটার হিসাব রেখে কাজ করতে হলে ডাইরি লেখা একান্ত প্রয়োজন।
প্রতিদিন শুধু সাক্ষাৎ বাড়ালেই সাফল্য আসবে না। সুপরিকল্পিতভাবে সাক্ষাতের সঙ্গে আনুষঙ্গিক কাজ করে যেতে হবে। আর এটা করতে হলে অবশ্যই আপনাকে সবকিছূ রেকর্ড রাখতে হবে। আমেরিকাতে একজন বিখ্যাত সেলস ম্যান হ্যমলিন বীমা পেশায় তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন, I failed three times in selling before I began keeping record”. অর্থাৎ এর আগে আমি তিন তিন বীমা পেশায় ব্যর্থকাম হয়েছি, কারণ তখন আমি রেকর্ড রাখতাম না। আমেরিকার আর এক বিখ্যাত বীমা প্রতিভা Frank Bettger বলেছেন, “Without records, we have no way of knowing what we are doing wrong. I can get more inspiration out of studying my own records, than anything I can record in a magazine.” অর্থাৎ রেকর্ড না রাখলে কোথায় ভুল করছি তা জানা যাবে না। তাছাড়া রেকর্ড না রাখলে কি করেছি তা পড়ে যে উৎসাহ লাভ করি একটি ম্যাগাজিন পড়ে সে উৎসাহ পাওয়া যায় না।
একটি পলিসি বিক্রি করার পর পলিসি গ্রাহকদের সেবার জন্য আরো কিছু বিষয় ডাইরিতে অথবা রেজিস্টারে লিখে রাখতে হবে। যেমন -
১) প্রস্তাবপত্র, ডাক্তারি পরীক্ষাবিহীন অতিরিক্ত বিবৃতি বা ডাক্তারি রিপোর্টের প্রয়োজনীয় তথ্য: পলিসি হওয়ার পর পলিসি নম্বরসহ একটি প্রস্তাব পত্রের বিস্তারিত তথ্য এবং প্রস্তাবকের শারীরিক পরিমাপ, পারিবারিক ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় ডাইরিতে লিখে রাখতে হবে। এগুলি পরবর্তীতে প্রচুর কাজে লাগে। এছাড়া পলিসি গ্রাহকের ছেলে মেয়েদের নাম, জন্ম তারিখ, পলিসি গ্রাহণের তারিখ লিখে রাখবেন। পরে ছেলে মেয়েদের জন্ম দিনে বা তার বিবাহের দিনে একটি কার্ড পাঠালে গ্রাহক খুশি হবে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন বীমা গ্রাহক একাধিক পলিসি গ্রহণ করেন। সে সমস্ত রেকর্ডগুলি যত্নসহকারে রাখলে পরবর্তীতে যথেষ্ট কাজে লাগবে।
২) নবায়ন রেজিস্ট্রার: একজন বিপণন কর্মীর অসংখ্য পলিসি গ্রাহক থাকে। আর বেশির ভাগ গ্রাহকদের সহিত যোগাযোগ না রাখলে নবায়ন পলিসি জমা দিতে চায় না। ফলে আপনাকে একটি নবায়ন রেজিস্ট্রার অবশ্যই রাখতে হবে এবং কোন গ্রাহক কখন প্রিমিয়াম দেওয়ার সময় হচ্ছে তাহা দেখতে হবে। সাধারণত বীমা কোম্পানিগুলি প্রিমিয়ায় নোটিশ প্রদান করে থাকেন। কিন্ত আপনি নির্ধারিত সময়ের এক মাস আগে একটি পোস্টকার্ড লিখে আপনার গ্রাহককে প্রিমিয়াম পরিশোধসহ একটু ব্যক্তিগত খোঁজ খবর নিবেন। আর এর জন্য অবশ্যই আপনাকে একটি নবায়ন রেজিস্ট্রার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
৩) তামাদি রেকর্ড: পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, একটি পলিসি তামাদি হওয়া ক্যান্সার রোগের মত। কেননা এর কুফল বিভিন্ন ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। যথেষ্ট সতর্কতা সত্বেও বিভিন্ন কারণে কিছু কিছু পলিসি তামাদি হয়ে যেতে পারে। এর একটি তালিকা আপনাকে রাখতে হবে এবং যখন সময় পাওয়া যাবে একটি নতুন ক্রেতা ও একটি তামাদি পলিসি পুনর্বহালের জন্য বীমা গ্রাহিতার সহিত যোগযোগ করতে হবে। একটি তামাদি পলিসি পুনর্জীবন করা একজন বীমা কর্মীর সব থেকে বড় সাফল্য । অর্থাৎ তিনি একটি ক্যান্সার রোগ ভাল করলেন। আর এর জন্য তামাদি পলিসির একটি রেজিস্ট্রার রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত।
৪) লাইসেন্স রেজিস্ট্রার: এই কাজটি ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আপনি এজেন্ট হলে আপনার লাইসেন্স নম্বর, মেয়াদ উত্তীর্ণের সময়, ইত্যাদি লিখে রাখবেন। কেননা লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে কোন বিল পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে আপনি যদি একজন যোগ্য সংগঠক হন তবে আপনার ইউনিটে প্রত্যেক এজেন্ট, এমওদের লাইসেন্স নম্বর মেয়াদ উর্ত্তীর্ণর তারিখ ও অন্যান্য বিবরণী লিখে রাখবেন। কেননা লাইসেন্স নবায়নের সময় এগুলি প্রয়োজন পড়বে বা সময় মত এজেন্ট ও মাকের্টি অফিসারদের লাইসেন্স নবায়নের জন্য তাগিদ দেওয়া যাবে।
৫) প্রোগ্রেসিভ রিপোর্ট রেজিস্ট্রার: এই রেজিস্ট্রারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি সপ্তাহে নিজের কাজের স্বার্থকতা ও ব্যর্থতার একটি তালিকা এই রেজিস্টারে রাখা যেতে পারে। কেননা “সে হচ্ছে সবচেয়ে বুদ্ধিমান, যে নিজকে সমালোচনা করে।” এ রেজিস্টারটি রাখলে সে নিজের দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করতে পারবে এবং আত্মসংশোধনের সুযোগ পাবে। ব্যর্থতা হচ্ছে সতর্কতার সিঁড়ি । সুতরাং লজ্জার কিছু নয়, ব্যর্থতার রেকর্ড রাখতে দ্বিধা করবেন না। এটি আপনার ভবিষ্যৎ সফলতার পথ নিদেশনা দিবে। তাই একটি প্রগ্রেসিভ রিপোট রেজিস্ট্রার বীমা প্রতিনিধিদের রাখা একান্ত কর্তব্য।
৬) জন্ম ও মৃত্যু রেজিস্ট্রার: প্রত্যেক দেশ ও জাতির জন্য এই রেকর্ডটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন বীমা কর্মী প্রতিনিয়ত মানুষের মাঝে তার এলাকায় বিচরণ করে। ফলে একটু মনোযোগ দিলেই এ বিষয়টিও সে তার ডায়েরিতে লিখে রাখতে পারে। মানুষের সমস্ত রুজি-রোজগার, ছেলে মেয়েদের অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। একজন লোকের একটি ছেলে বা মেয়ে হলো তার রেকর্ড থাকলে সুবিধামত বীমা কর্মী উক্ত ব্যক্তির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বীমা প্রস্তাব দিতে পারবেন। প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার এই রেকর্ড রাখার দায়িত্ব রয়েছে কিন্তু তারা সেটা গুরুত্ব সহকারে পালন করছেন না। ফলে এ রেকর্ডটি যদি একজন বীমা কর্মী রাখে তবে তার সম্ভাব্য ক্রেতা অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হবে।
অন্যদিকে একটি মৃত্যুর তালিকা রাখলে সম্ভাব্য ক্রেতাদের বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বুঝানো সম্ভব হবে। এই বিষয়টি সম্ভাব্য ক্রেতাদের বিভিন্ন আপত্তির মোকাবিলা করার একটি বাস্তব মাইল ফলক হয়ে দেখা দিবে। তাই একজন বীমা কর্মীর জন্য একটু কষ্ট হলেও তিনি যে এলাকয়ে কাজ করছেন সেই এলাকার একটি জন্ম ও মৃত্যুর রেকর্ড রাখা দরকার।
লেখক: সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে কোম্পানি লিমিটেড’র এডিশনাল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর অ্যান্ড সিএফও।