অবলিখন সিদ্ধান্ত প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

সৈয়দ আব্দুল্লাহ জাবির:

সহজ কথায় অবলিখন হচ্ছে ঝুঁকি নির্বাচন (Selection of Risk) । ঝুঁকি বলতে এমন কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনা বা ঘটার সম্ভাবনা বুঝায় বা ঘটলে সম্পদ বা জীবন বা উভয়ের ক্ষতি সাধন হতে পারে। জীবন বীমার ঝুঁকি বলতে মৃত্যু বা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে বুঝায়। বিশদভাবে বলা যায়, অবলিখন হচ্ছে জীবন বীমা শিল্পের একটি বিশেষ টেকনিক্যাল প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবন বীমা প্রস্তাবকের সম্ভাব্য অতিরিক্ত মৃত্যু ঝুঁকি ও স্বাভাবিক মৃত্যুর হার বিবেচনা করে প্রস্তাবকের প্রস্তাবিত ঝুঁকি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে কিনা বা কোন শর্ত সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্য হবে তা বিবেচনা করা। সর্বোপরি প্রস্তাবিত ব্যক্তির জীবন বীমা ঝুঁকি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রয়োজনীয় প্রিমিয়াম নির্ধারণ সাপেক্ষে গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা করাই অবলিখন।

জীবন বীমায় অবলিখনের মৌলিক নীতিমালা (Fundamental Principle of Underwriting) পৃথিবীতে বিভিন্ন দেশে একই। কিন্তু অবলিখন নীতিমালার প্রয়োগ (application) বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কোম্পানীতে সময় ভেদে, একই কোম্পানীতে অবলিখক ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এমনকি একই অবলিখকের অবলিখন সিদ্ধান্ত বিভিন্ন দিনে, বিভিন্ন সংগঠনের দ্বারা দাখিলকৃত প্রস্তাবপত্রের ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

সাধারণভাবে বলা যায়, অবলিখন সিদ্ধান্ত নির্ভর করে কোন জীবন বীমা কোম্পানীর আর্থিক ভিত্তি, মৃত্যুদাবীর অভিজ্ঞতা, অবলিখকদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, কোম্পানীর ব্যবসায় ঝুঁকি গ্রহণের ব্যপারে দৃষ্টিভঙ্গী, পুনর্বীমা চুক্তির শর্তাবলী, পুনর্বীমাকারীর আর্থিক অবস্থা, সর্বোপরি বীমার মৌলিক নীতিমালা পরিপালনের উপর। মোট কথা জীবন বীমা কোম্পানীর Risk perception, Risk appetite এর উপর। অবলিখন বিভাগকে খারাপ জীবন (Bad life) পরিহারের পাশাপাশি যাতে কোম্পানীর নতুন ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি বজায় থাকে সে ব্যাপারেও দৃষ্টি রাখতে হয়।

১. বয়স: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের নানা রকম অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে থাকে। চল্লিশ এর উপরে বয়সী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেড়ে যায়। সাধারণত এই সময়েই মানুষ উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এর মত জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। তাই প্রস্তাবকের বয়স অবলিখন সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

(ক) জীবন বীমা পলিসি করার জন্য বীমার শুরুতে প্রস্তাবকের নূন্যতম বয়স হতে হবে ১৮ (আঠার) বছর। কেননা বীমাসহ অন্য যে কোন চুক্তি সম্পাদনের জন্য কোন ব্যক্তির নূন্যতম বয়স হতে হয় ১৮ বছর। অর্থাৎ ১৮ বৎসর বা তদুর্ধ্ব বয়সের যে কোন ব্যক্তিকে প্রাপ্ত বয়স্ক হিসাবে ধরা হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রে বীমা শুরুর সর্বোচ্চ বয়স সাধারণত ৫০ বছর। স্বোপার্জিত আয়হীন এসএসসি পাশ নয় এমন মহিলা প্রস্তাবকদের ক্ষেত্রে এটি সাধারণত ৪৫ বছর। এসএসসি পাশ মহিলা প্রস্তাবকদের ক্ষেত্রে বীমার শুরুতে সর্বোচ্চ বয়স সাধারণত ৫০ বছর।

(খ) তেমনি বীমার মেয়াদ পূর্তিতে প্রস্তাবকের বয়স একটি সীমার মধ্যে থাকতে হয়। সাধারণত সকল প্রস্তাবকের ক্ষেত্রে অধিকাংশ পরিকল্পে মেয়াদপূর্তিতে সর্বোচ্চ বয়স ধরা হয় ৬০ বছর। মেয়াদপূর্তিতে বয়সের এই সীমা বিবেচনা করে বীমার মেয়াদ নির্ধারণ করতে হবে। বীমার শুরুতে প্রস্তাবকের বয়স ও বীমা অংক/বীমা ঝুঁকি অংকের উপর ভিত্তি করে প্রিমিয়াম হিসাব করা ও অবলিখন চাহিদাদি (Underwriting Requirements) নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

(গ) বয়স প্রমাণপত্র হিসাবে এসএসসি সার্টিফিকেটের সত্যায়িত ফটোকপি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্রহণ করা হয়। এছাড়াও বয়স প্রমাণপত্র হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার আইডি কার্ড, পাসপোর্ট ও চাকুরীর নথি গ্রহণ করা হয়।

(ঘ) বীমার শুরুতে বয়স ও বীমা ঝুঁকি অংকের উপর ভিত্তি করে অবলিখন চাহিদাদি (Underwriting Requirements) নির্ধারণ করা হয়। কেননা কম বয়সী প্রস্তাবকের চেয়ে বেশি বয়সের প্রস্তাবকের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি।  বীমা অংক /বীমা ঝুঁকি অংক একই হলেও বয়সের তারতম্যের কারণে অবলিখন চাহিদা ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ৩৭ বছর বয়সী একজন প্রস্তাবকের বীমা অংক ১ লাখ টাকা এখানে সাধারণভাবে অবলিখন চাহিদা হবে ডাক্তারি পরীক্ষা বিহীন অতিরিক্ত বিবৃতি (NMDF)ও বয়স প্রমাণপত্র। কিন্তু ৪৬ বছর বয়সের কোন প্রস্তাবকের ক্ষেত্রে একই বীমা অংকের বেলায় বিভিন্ন মেডিকেল পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে কোম্পানী ভেদে। অনেক সময় দেখা যায় যে, পাসপোর্টে বা জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রস্তাবকের বয়স ঠিকমত উল্লেখ করা হয় না। সঠিক বয়সের পরিবর্তে প্রস্তাবকের বয়স কম/বেশি উল্লেখ করা হয়। যদি প্রস্তাবকের বয়স জাতীয় পরিচয়পত্র বা অন্য কোন বয়স প্রমাণপত্রে তার প্রকৃত বয়স থেকে কম উল্লেখ করা হয় তবে সেক্ষেত্রে তেমন জটিলতা দেখা দেয় না। এক্ষেত্রে বীমা গ্রাহককে বিকল্প সঠিক বয়স প্রমাণ হিসেবে পাসপোর্ট/ এসএসসির সনদ/ জন্মসনদ/ কাবিন নামার ফটোকপি/ বয়সের নিজস্ব ঘোষণাপত্র/ দাখিল করতে হবে। এছাড়া তাকে বীমা কোম্পানী বরাবর একটি  লিখিত চিঠি প্রদান করতে হবে যে, জাতীয় পরিচয়পত্র / অন্য কোন বয়স প্রমাণপত্রে তার বয়স কম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে পাসপোর্টে/ কাবিন নামায়/ জন্মসনদে উল্লেখিত তার বয়সই সঠিক এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে বা অন্য কোন বয়স প্রমাণপত্রে উল্লেখিত প্রস্তাবকের বয়স তার প্রকৃত বয়স অর্থাৎ প্রস্তাবপত্রে উল্লেখিত বয়স থেকে যদি বেশি হয় বিশেষত এতটাই বেশি হয় যে, পার্থক্যের কারণে জীবন বীমার প্রস্তাবটি  বীমার  শুরুতে সর্বোচ্চ বয়সের সীমা অতিক্রম করার কারণে প্রত্যাখ্যান করা হবে, সেক্ষেত্রে জীবন বীমা কোম্পানী এই বীমা প্রস্তাব গ্রহণ নাও করতে পারে। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, প্রায় সকল ক্ষেত্রেই মিথ্যা তথ্য প্রদান করা হয়। উদাহরণস্বরূপ কোন গ্রাহকের প্রস্তাবপত্রে উল্লেখিত বয়স তার প্রকৃত বয়স (বয়স প্রমানপত্রে উল্লেখিত বয়স) থেকে কম দেখানো হয় অর্থাৎ অসৎ উদ্দেশ্যে বীমা করার জন্য প্রস্তাবপত্রে তার বয়স কম দেখানো হয়।  কিন্তু সংশ্লিষ্ট  উন্নয়ন  কর্মকর্তা এই ক্ষেত্রে লিখিত দরখাস্ত দিয়ে বলেন, প্রস্তাবকের প্রকৃত বয়স মূলত ৪৫ বছর। ভুলক্রমে জাতীয়  পরিচয়পত্রে ৫৬ উল্লেখ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রস্তাবককে তার প্রকৃত বয়স প্রমাণ করার জন্য  পাসপোর্ট/ নিকাহ নামা (প্রস্তাবপত্রে দাখিলের  পূর্বে ইস্যুকৃত)/ চাকুরির নথি ইত্যাদি গ্রহণযোগ্য বিকল্প বয়স প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে ও এই বিষয়ে প্রস্তাবককে একটি লিখিত চিঠি দিতে হবে যে জাতীয় পরিচয়পত্রে উল্লেখিত তার ৫৬ বছর বয়স ঠিক নয়।  এক্ষেত্রে প্রস্তাবকের প্রকৃত বয়স ৪৫ বছর যা পাসপোর্টে/ কাবিন নামায়/ চাকুরির নথিতে উল্লেখ করা আছে।

২. বীমা অংক/ বীমা ঝুঁকি অংক:  অবলিখন সিদ্ধাস্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন প্রস্তাবক তার নিজের ইচ্ছামত পলিসির বীমা অংক নির্ধারণ করতে পারে না। প্রস্তাবকের পলিসির প্রিমিয়াম তার আয় ও ব্যয়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। বীমার শুরুতে প্রস্তাবকের বয়সের পাশাপাশি বীমা অংক/ বীমা ঝুঁকি অংকের উপর ভিত্তি করে অবলিখন চাহিদাদি নির্ধারণ করা হয়।  বীমা অংক বৃদ্ধির সাথে সাথে অবলিখন চাহিদাদিও বৃদ্ধি পায়। কোন কোন  ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পের জন্য বীমা অংক নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন Premium Back Term Insurance Plan বা অন্য কোন Plan এর পলিসির জন্য সর্বোচ্চ বীমা অংকের পরিমাণ সীমিত করে দেয়া হতে পারে।

৩. বীমার মেয়াদ: বীমার মেয়াদ অবলিখনের ক্ষেত্রে অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। এ্যাকচুয়ারি কর্তৃক প্রণীত বিভিন্ন পরিকল্পের জন্য বিভিন্ন মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। । উদাহরণস্বরূপ তিন কিস্তি বীমার ক্ষেত্রে বীমার মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ১২, ১৫, ১৮, ২১, ২৪ । প্রস্তাবককে এই মেয়াদের যে কোন একটি মেয়াদেই পলিসি গ্রহণ করতে হবে। তিনি ইচ্ছে করলে এই পরিকল্পে ১১ বা ১৩ বছরের মেয়াদী পলিসি নিতে পারবে না।

আবার বীমার মেয়াদ নির্ধারণের ক্ষেত্রে মেয়াদপূর্তিতে প্রস্তাবকের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য বয়সের বীমাকে বিবেচনায় আনতে হবে। উদাহরণস্বরূপ এসএসসি পাশ নয় এরুপ পুরুষ প্রস্তাবকের মেয়াদ পূর্তিতে সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য বয়সের সীমা ৬০ বছর।  একজন প্রস্তাবকের বীমার শুরুতে বয়স ৪০ বছর। তিন কিস্তি পরিকল্পের জন্য ২১বছর মেয়াদে পলিসি গ্রহণযোগ্য  কিন্তু যেহেতু মেয়াদপূর্তিতে প্রস্তাবকের সর্বোচ্চ বয়স হবে ৬০ (ষাট) বছর। তাই তিনি ২১ (একুশ) বছর মেয়াদে পলিসি নিতে পারবেন না। তিনি সর্বোচ্চ  ১৮ (আঠার) বছর মেয়াদে পলিসি গ্রহণ করতে পারবেন। দীর্ঘ মেয়াদে পলিসি প্রদানযোগ্য হলেও অবলিখন দৃষ্টিকোন থেকে কোম্পানীর জন্য তা অধিকতর আর্থিক ঝুকিঁর সৃষ্টি করে।

৪. পরিকল্প: পরিকল্প হচ্ছে বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা ও শর্ত সম্বলিত কোম্পানীর পণ্যসমূহ (Product) । জীবন বীমা কোম্পানী একাধিক পরিকল্প বাজারজাত করে থাকে। এদের মধ্যে আছে মেয়াদী বীমা, পেনশন বীমা, সাময়িক বীমা ইত্যাদি। কোম্পানীর সকল পরিকল্পই সকল ধরনের প্রস্তাবকদের জন্য উন্মুক্ত নয়। যেমন পেনশন বীমা পরিকল্প/ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায়      প্রস্তাবক বা গৃহিনীদের ক্ষেত্রে প্রদেয়  নয়। কেননা গৃহিনীদের সুনির্দিষ্ট  ও নিয়মিত আয় নেই এবং ঝুঁকিপূর্ণ পেশার প্রস্তাবক যেমন- রাজমিস্ত্রীর মৃত্যুঝুঁকি সাধারণ ঝুকিঁর চেয়ে বেশি। প্রিমিয়ামের তুলানায় অনেক বেশি। একই বীমা অংকের ক্ষেত্রে পরিকল্প ভেদে বীমা ঝুঁকি অংক ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরুপ সঞ্চয়ী বীমা পরিকল্পের এক লাখ টাকা বীমা অংকের একটি পলিসির বীমা ঝুঁকি অংক ১ লাখ টাকাই। কিন্তু শিশু নিরাপত্তা বীমার ক্ষেত্রে ১ লাখ টাকা বীমা অংকের পলিসির বীমা ঝুঁকি অংক ১ লাখ  টাকার বেশি। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন পরিকল্পের জন্য বীমার বিভিন্ন মেয়াদ নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে এবং কিছু পরিকল্পের বীমা অংকের পরিমাণও নির্দিষ্ট করা হতে পারে।  যেমন- প্রিমিয়াম ফেরত সাময়িক বীমার ক্ষেত্রে।

৫. প্রিমিয়াম প্রদান পদ্ধতি: একজন প্রস্তাবক তার পলিসির প্রিমিয়াম ত্রৈমাসিক/ ষান্মাসিক/ বার্ষিক যে কোন একটি পদ্ধতিতে প্রদান করতে পারে। অর্থাৎ তিনি ইচ্ছে করলে প্রতি বছর তার পলিসির প্রিমিয়াম বছরে চারটি সমান কিস্তিতে, দুইটি সমান কিস্তিতে বা একটি মাত্র কিস্তিতে প্রদান করতে পারেন। ক্ষুদ্র বীমার (Micro Insurance) ক্ষেত্রে মাসিক (Monthly) পদ্ধতিতে প্রিমিয়াম গ্রহণ করা হয়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে পরিকল্প বিশেষের জন্য প্রিমিয়াম প্রদান পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট করে দেয়া থাকতে পারে। যেমন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পের জন্য প্রিমিয়াম প্রদান পদ্ধতি হবে বার্ষিক। তবে অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় মাসিক, ত্রৈমাসিক ও ষান্মাসিক পদ্ধতিতে প্রদেয় প্রিমিয়ামের পলিসির তামাদির হার (Lapsation) তুলনামূলক বেশি।

৬. প্রস্তাবকের পেশা: প্রস্তাবকের পেশা অবলিখন সিদ্ধান্ত প্রদানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমন কিছু পেশা আছে যে সকল পেশার প্রস্তাবকের মৃত্যুজনিত ঝুঁকি এতই বেশি যে জীবন বীমা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ এই সকল পেশার লোকদের জীবন বীমা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় না। যেমন সিনেমার ডামি, গভীর সমুদ্রের ডুবুরী, সার্কাসের শিল্পী, মুষ্টিযোদ্ধা ইত্যাদি। আবার কোন কোন পেশায় অতিরিক্ত মৃত্যু ঝুঁকি থাকলেও পেশাগত অতিরিক্ত প্রিমিয়াম গ্রহণ করে পলিসি গ্রহণ করা হয়। যেমন একজন রাজ মিস্ত্রীর জীবনে পেশাগত কারণে অতিরিক্ত মৃত্যু ঝুঁকি থাকায় অতিরিক্ত প্রিমিয়াম (প্রতি হাজার টাকা বীমা অংকের জন্য ২ টাকা/ ৪ টাকা হারে) গ্রহণ করে পলিসি নেয়া হয়।

কোন কোন পেশার প্রস্তাবককে আবার সহযোগী বীমার সুবিধা দেয়া হয় না। কিন্তু পেশাগত কারণে অতিরিক্ত প্রিমিয়াম আদায় করা হয়। যেমন- সমুদ্রের জেলেদের সাধারণত সহযোগী বীমার সুবিধা দেয়া হয় না। এদের ক্ষেত্রে পেশাগত অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নিয়ে ঝুঁকি গ্রহণ করা হয়। আবার কিছু পেশা রয়েছে যাদের মূল পেশার উপর কোন অতিরিক্ত প্রিমিয়াম নেয়া হয় না। কিন্তু সহযোগী বীমার প্রিমিয়ামের উপর অতিরিক্ত প্রিমিয়াম আদায় করা হয়। যেমন- সেনাবাহিনীর অফিসার/ সৈনিকদের ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন পেশাগত অতিরিক্ত প্রিমিয়াম গ্রহন করা হয় না। কিন্তু তাদেরকে সহযোগী বীমা পিডিএবি/ ডিআইএবি দেবার ক্ষেত্রে  অতিরিক্ত প্রিমিয়াম আদায় করা হয়।

৭. প্রস্তাবকের আয়: বীমা করার জন্য একজন প্রস্তাবকের সাংসারিক নিত্য প্রয়োজনীয় খরচ নির্বাহের পর প্রিমিয়াম দেবার মত পর্যাপ্ত আয় থাকতে হবে। প্রস্তাবকদের নিজস্ব আয় না থাকলেও বাংলাদেশে জীবন বীমা কোম্পানীগুলো স্বামীর আয়ের উপর নির্ভর করে গৃহবধুদের নির্দিষ্ট বীমা অংকের পলিসি প্রদান করে থাকে। বলা যায় যে বার্ষিক প্রিমিয়ামের পরিমান প্রস্তাবকের বার্ষিক আয়ের ১৫% বেশি হওয়া উচিত নয়। কেননা একজন প্রস্তাবকের পক্ষে খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, ইউটিলিটি বিলের খরচ যোগানোর পর আয়ের ১৫% বেশি সঞ্চয় করা কঠিন ব্যাপার। একবারে যাদের কোন আয় নেই সেই সকল প্রস্তাবকদের জীবন বীমা প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়, যেমন বেকারদের। কেননা No income- No insurable interest-No life insurance policy.

৮. শারীরিক পরিমাপ (Physical Measurement): শারীরিক পরিমাপ বলতে বুঝায় কোন ব্যক্তির উচ্চতা, ওজন, বুকের মাপ, কোমরের মাপ। শারীরিক পরিমাপ বয়স অনুপাতে সঠিক না থাকলে অসুখ বিসুখে আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যু ঝুঁকির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। যেমন ওভারওয়েট ব্যক্তির ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। আবার কম ওজন বিশিষ্ট লোকদের যক্ষ্মা ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এসব লোকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় সহজেই সে কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়তে পারে। বামন আকৃতির লোকদের জীবন বীমা পলিসি দেয়া হয় না।

মানুষের দৈহিক মাপের সাথে ওজনের একটি সম্পর্ক রয়েছে।

স্বাভাবিক ওজন (পাউন্ড) = উচ্চতা (ইঃ) দ্ধ  শ্বাসত্যাগের পর বুকের মাপ (ইঃ) ।

                                                     ১৭

৯. পারিবারিক ইতিহাস (Family History): মানুষের অনেক গুরুতর অসুখ বংশগত প্রভাবের কারণে আক্রান্ত হয়। যেমন-পরিবারের পূর্ব পুরুষ (পিতা-মাতা, চাচা-মা, খালা, দাদা-দাদী, নানা-নানী) আরও অনেক পূর্বের কোন বংশধর কিছু নির্দিষ্ট অসুখে আক্রান্ত হয়ে থাকলে পরিবারের সদস্যরা সহজেই ঐ সকল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মৃগী রোগ, রক্ত শূন্যতা, যক্ষা ইত্যাদি বংশগত রোগের আদর্শ উদাহরণ। যেমন কোন প্রস্তাবকের পিতা/মাতা যে কেউ ডায়াবেটিস/উচ্চ রক্ত চাপে আক্রান্ত হয়ে থাকলে প্রস্তাবকের এই সকল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

আবার পিতা/মাতা উভয়েই এই সকল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে সন্তানের নির্দিষ্ট বয়সে এই সকল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তাই অবলিখকগণকে কোন প্রস্তাবকের ঝুঁকি গ্রহণের পূর্বে পরিবারের কেউ এই সকল রোগে ভুগেছে কিনা বা ভুগে মারা গেছেন কিনা তা সতর্কতার সাথে পরীক্ষা করা উচিত। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে অবলিখন বিভাগের মেডিকেল কনসালট্যান্টের সাথে আলাপ করে/ রি-ইনসিওরারের মতামত নিয়ে ঝুঁকি গ্রহণ করা উচিত।

পরিবারের সদস্যদের স্বল্পায়ু/দীর্ঘায়ু হওয়ার বিষয়টি অবলিখন সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। পারিবারিক ইতিহাসে যদি দেখা যায় যে, পরিবারে পিতামাতাসহ একাধিক সদস্য অল্প বয়সের মৃত্যুবরণ করেছেন তাহলে অবলিখককে সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে অবলিখক প্রয়োজনবোধে বীমার মেয়াদ হ্রাস করে বা পরিকল্প পরিবর্তন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।

১০. মনোনীতক (Nominee): মনোনীতক বা নমিনী হল সেই ব্যক্তি যিনি কোন বীমা গ্রাহকের মৃত্যুতে বীমার আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে থাকেন। প্রচলিত বীমা আইন/প্রথা অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী, সন্তান, পিতা/মাতা পরষ্পরের জীবনের উপর নেয়া পলিসির নমিনী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। এছাড়াও মালিক-কর্মচারী, দেনাদার-পাওনাদার, ব্যবসায়ের অংশিদারগণ পরস্পরের জীবনের উপর গৃহীত পলিসির নমিনী হতে পারবেন। পলিসিতে কোন ব্যক্তির মনোনীতক হতে হলে তার বীমা গ্রাহকের জীবনের উপর বীমাযোগ্য স্বার্থ (Insurable interest) থাকতে হবে। এই বীমাযোগ্য স্বার্থ প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী অবিসংবাদিতভাবে স্বীকৃত হতে হবে।

১১. প্রস্তাবকের অতীত অসুখ -বিসুখ ও দুর্ঘটনার ইতিহাস: প্রস্তাবকের অতীতে বিশেষ নিকট অতীতে গুরুতর অসুখ যেমন জন্ডিস, যক্ষ্মা, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকলে বা কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনার আক্রান্ত হয়ে থাকলে প্রস্তাবককে অবশ্যই তা ডাক্তারী পরীক্ষা বিহীন অতিরিক্ত বিবৃতিতে/পূর্ণ ডাক্তারী পরীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে আলাদা কাগজপত্র ব্যবহার করতে হবে। প্রস্তাবক হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকলে হাসপাতালের ছাড়পত্র বা বাসায় থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা নিয়ে থাকলে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন দাখিল করতে হবে।

এই সকল ডকুমেন্ট ও তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে অবলিখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। বীমাপ্রস্তাব আদৌ গ্রহণ করা যাবে কিনা কিংবা কি শর্তে তা গ্রহণ করা যাবে অথবা প্রস্তাবপত্র স্থগিত রাখা হবে কিনা বা তা প্রত্যাখ্যান করা হবে। এক্ষেত্রে অবলিখন বিভাগের প্রধান প্রয়োজনবোধে কোম্পানীর মেডিকেল কলসান্ট্যান্ট/রি ইনইসওরারের দিক নির্দেশনা গ্রহণ করে থাকেন।

১২.লিঙ্গ (Sex): বাংলাদেশে প্রস্তাবকদের লিঙ্গ (Sex) অবলিখন চাহিদার তার তম্য ঘটে। বিশেষত এসএসসি পাশ নয় এমন মহিলাদের উপর অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত প্রিমিয়াম ধার্য্য করা হয়। অথচ এসএসসি পাশ নয় এমন পুরুষ প্রস্তাবকদের লিঙ্গ জনিত কারেণ কোন অতিরিক্ত প্রিমিয়াম ধার্য্য করা হয় না। আবার বাংলাদেশের অধিকাংশ জীবন বীমা কোম্পানী স্বোপার্জিত আয় বিহীন মহিলাদের ক্ষেত্রে স্থায়ী/ ক্রমহ্রাসমান লিয়েন আরোপ করে থাকে। স্বোপার্জিত আয় বিহীন মহিলাদের জন্য সর্বোচ্চ বীমা অংকের সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।  অনেক জীবন বীমা কোম্পানী স্বোপার্জিত আয় বিহীন মহিলা পস্তাবকদের সহযোগী বীমার সুবিধা প্রদান করেনা।

১৩. সহযোগী বীমা (SupplementaryInsurance): মূল বীমার (পরিকল্পের) সাথে সামান্য প্রিমিয়ামের বিনিময়ে যে বীমার মাধ্যমে তুলনামুলক অনেক বেশি আর্থিক সুবিধা দেয় তাকেই সহযোগী বীমা বলে। শুধুমাত্র মূল পরিকল্পের সাথেই সহযোগী বীমা নেয়া যায়। আলাদা ভাবে নেয়া যায় না। সব পরিকল্পের সাথে সহযোগী বীমা দেয়া হয় না । বহুল প্রচারিত দুইটি সহযোগী বীমা হলো-

(১)    দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বীমা (Double Indemnity and Accident Benefit (DIAB)

(২)   স্থায়ী অক্ষমতা ও দুর্ঘটনা বীমা (Permanent Disability and Accident Benefit (PDAB)

১৪. নৈতিক ঝুঁকি (Moral Hazard): নৈতিক ঝুঁকি হল বীমা প্রস্তাবক কর্তৃক তথ্য গোপন করে বা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে বীমা করার প্রচেষ্টার ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি। এছাড়া প্রস্তাবকের স্বভাব-চরিত্র, আচার আচরণ, জীবন যাপন প্রণালী নৈতিক ঝুঁকির সৃষ্টি হতে পারে। যে সকল কারণে একজন প্রস্তাবক তথ্য গোপন করে থাকেন-

ক) অল্প কিছুদিন বা বছরের মধ্যে মৃত্যু হবে এ তথ্য জানা থাকলে অনেক সময় প্রস্তাবক তথ্য গোপনের মাধ্যম জীবন বীমা পলিসি গ্রহণে আগ্রহী হন। যেমন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী।

খ) বীমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রস্তাবপত্র গ্রহণ না করার দুঃশ্চিন্তা থেকেও অনেক সময় প্রস্তাবক তথ্য গোপন করে থাকেন। যেমন বাতজ্বর জনিত (Rheumatic fever) রোগের ইতিহাস।

গ) বীমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক তদন্ত বা অতিরিক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার রিপোর্ট জমা দানের চাহিদা আসতে পারে এ ভয়েও অনেকে তথ্য গোপন করে থাকেন।

ঘ) অনেক প্রস্তাবক মনে করেন তার ব্যক্তিগত ও পারিাবরিক ইতিহাস জীবন বীমা প্রতিষ্ঠানের নিকট প্রকাশ করা হলে তা জানাজানি হয়ে যাবে। তাই অনেকে সঠিক তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকে।

ঙ) অনেকে মনে করে অতীতে রোগাক্রান্ত হয়েছেন পরে চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেছেন কাজেই এই বিষয়টি বীমা প্রতিষ্ঠানকে জানানো কোন প্রয়োজন নেই। যেমন- সার্জিক্যাল অপারেশনের ইতিহাস।

নৈতিক ঝুঁকি সন্দেহযুক্ত প্রস্তাবপত্রের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় সমূহ:

ক) প্রস্তাবকের অবস্থানের বাইরের কোন জায়গা থেকে ডাক্তারী পরীক্ষা রিপোর্ট সম্পন্ন করা।

খ) মনোনীতক নিকটবর্তী নির্ভরশীল ব্যক্তি না হলে।

গ) যোগাযোগের ঠিকানা সংশ্লিষ্ট এজেন্টের থাকলে।

ঘ) উচ্চ বীমা অংক।

ঙ) হঠাৎ বীমা অংক বৃদ্ধি করার প্রবণতা।

নৈতিক ঝুঁকি মোকাবেলায় অবলিখকের জন্য অনুসরণীয় পদেক্ষেপসমূহ:

ক) নৈতিক ঝুঁকিটি যদি বয়স সংক্রান্ত বিষয়ে সন্দেহ করা হয় তবে দাখিলকৃত বয়স প্রমানের পাশাপাশি অন্য যে কোন স্বীকৃত বয়স প্রমান গ্রহণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব।

খ) নৈতিক ঝুঁকিটি যদি পেশাগত বিষয়ে হয়, তবে পেশাগত প্রশ্নমালার উত্তর সংগ্রহ করতে হবে।

গ) নৈতিক ঝুঁকিটি যদি উচ্চ বীমা অংক সংশ্লিষ্ট হয় তবে প্রস্তাবক আয়কর সার্টিফিকেট/ ব্যাংক স্টেটমেন্ট/ স্যালারী সার্টিফিকেট চাওয়া যেতে পারে।

ঘ) নৈতিক ঝুঁকিটি মনোনীতক সংক্রান্ত বিষয় সংশ্লিষ্ট হয় তবে মনোনীতক পরিবর্তন করে তা নিরসন করা যায়।

ঙ) নৈতিক ঝুঁকিটি যদি সংশ্লিষ্ট বিপণন কর্মী ও প্রস্তাবকের সম্পৃক্ততা বিষয়ে সন্দেহ করা হয় তবে উর্ধ্বতন উন্নয়ন কর্মকর্তার গোপনীয় রিপোর্ট সংগ্রহের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়।

লেখক: ইভিপি (অবলিখন ও রি-ইনসিওরেন্স), প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড।