প্রগ্রেসিভ লাইফের দখল ফিরে পেল বজলুর রশিদ :আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধারে আইডিআরকে আদালতের নির্দেশ
বেসরকারি জীবন বীমা কোম্পানি প্রগেসিভ লাইফের দখল ফিরে পেয়েছে বজলুর রশিদ। আজ সন্ধায় বিপুল সংখ্যক পুলিশের সহযোগিতায় প্রগ্রেসিভ লাইফের দখল ফিরে পান তিনি।
এ বিষয়ে ইন্স্যুরেন্স নিউজবিডির সঙ্গে আলাপকালে বজলুর রশিদ জানান, আদালতে নির্দেশেই তিনি চেয়ারম্যান পদ ফিরে পেয়েছেন।এম এ করিমের অনুসারী পরিচালকদের সিদ্ধান্ত আদালত স্থগিত করেছে। সেই সঙ্গে তার চেয়ারম্যান পদে থাকা নিয়ে বিরোধী গ্রুপকে ঝামেলা না করার নির্দেশও দিয়েছে আদালত।
এছাড়াও কোম্পানির অডিটর হিসেবে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের নিরীক্ষার জন্য বার্ষিক ২ লাখ টাকা ফি নির্ধারণ করে হুদাভাসিকে নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে হুদাভাসির নিরীক্ষায় ওঠে আসা কোম্পানির আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বীমা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকেও নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানা বজলুর রশিদ।
এর আগে প্রগ্রেসিভ লাইফ দখল করে নেয় বর্তমান চেয়ারম্যান বজলুর রশিদের বিরোধী পক্ষ। ওই সময় কোম্পানিটির সঙ্গে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)’র সুসম্পর্ক স্থাপন হবে বলে দাবি করে দখলকারীরা।
গত ৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান বজলুর রশিদের বিরোধী পক্ষ দুর্নীতির অভিযোগে চাকুরিচ্যুত সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ করিমের অনুসারি পরিচালকদের এক বৈঠকের মাধ্যমে কোম্পানিটির কর্তৃত্ব দখল নেয়া হয়। দখলকারী পক্ষটি আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের আশীর্বাদপুষ্ট বলে জানা যায়।
এ সময় চেয়ারম্যান বজলুর রশিদকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। নতুন করে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান পদে বসানো হয় আব্দুল মালিক নামের একজন পরিচালককে। একই সঙ্গে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয় গোলাম মোস্তফা নামের আর এক পরিচালককে।
জানা গেছে, কোম্পানিতে দুর্নীতি অনিয়ম ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে পরিচালনা পর্ষদ। কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান বজলুর রশিদ’র নেতৃত্বে একভাগে রয়েছেন শিল্পপতি আজম জাহাঙ্গীর, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মিজানুর রহমান ও বাবেল মিয়া। অন্যপক্ষে রয়েছে বাকি ১০ জন পরিচালক। এ পক্ষে পরোক্ষভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ করিম।
কোম্পানিটির নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসি চৌধুরী অ্যান্ড কোং এর সাম্প্রতিক এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এম এ করিমসহ কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরা পড়ে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও উপদেষ্টা এমএ করিম, সাবেক সিনিয়র মহব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব শাখা) এনায়েত আলী খান, সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (সুজন বীমা বিভাগ) মো. মনিজুজ্জামান খান এবং সিনিয়র ব্যবস্থাপক (ইসলামী বীমা তাকাফুল বিভাগ) মো. রফিকুজ্জামান অনুমোদনহীন ভুয়া এজেন্টের নামে নিয়ম বহির্ভূত কমিশন, ভুয়া বিল দাখিল এবং একই রিনিউয়াল কমিশন একাধিবার দাখিল করে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই ৪ কর্মকর্তা অনুমোদনহীন ভুয়া এজেন্টকে নিয়ম বহির্ভূত কোড নাম্বার প্রদান করে অবৈধভাবে কমিশন প্রদানের মাধ্যমে কোম্পানির বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে। পাশাপাশি কয়েকটি সার্ভিসিং সেলের নামে ৭৯ লাখ ৬৭ হাজার ১২৩ টাকা আত্মসাৎ করেছে। এরমধ্যে স্থানীয় সার্ভিসিং সেলের নামে ৪৮ লাখ ২৮ হাজার ৭২ টাকা, এনেক্স সার্ভিসিং সেলের নামে ২৭ লাখ ৫৭ হাজার ৯৩ টাকা এবং বগুড়া শাখার সার্ভিসিং সেলের নামে ৩ লাখ ৪১ হাজার ৯৫৪ টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
এছাড়া এমএ করিম কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ৩ জন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সহযোগিতায় ভুয়া বিল দাখিল, একই বিল বারবার দাখিল, এমনকি নিজের স্ত্রীর টেলিফোন বিল গ্রহণসহ নানাবিধ খরচ দেখিয়ে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার ৭২৫ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এর মধ্যে ২০১০ সালে কোম্পানির তহবিল থেকে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৩২৫ টাকা, ২০১২ সালে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার ৮৬২ টাকা এবং বিভিন্ন সময়ে আরও ৬ লাখ ৩২ হাজার ৫৩৮ টাকা আত্মসাৎ করেন।
অবৈধ কমিশন ও ভুয়াবিলের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি জমি ক্রয়ের মাধ্যমেও কোম্পানির গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই কর্মকর্তারা ও সাবেক চেয়ারম্যান নাছির আলী।
এর মধ্যে ঢাকার আফতাব নগরে ২১ কাঠা জায়গা ক্রয়ের নামে সাবেক চেয়ারম্যান নাছির আলী ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। আর চট্টগ্রামের ডবমুরিং থানার আকারাবাদ মৌজার আরএস খতিয়ান নম্বর ১৭৬ ও ২৫৬, আরএস দাগ নম্বর ৫০৬ ও ৫৯৭ অবস্থিত ভবনের তৃতীয় তলায় ফ্লোর কেনার নামে ৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এমএ করিম।
কোম্পানির সাবেক সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব শাখা) এনায়েত আলী খান, সাবেক প্রধান নিরীক্ষক ও বর্তমান সিনিয়র মহাব্যবস্থাপক (সুজন বিমা বিভাগ) মো. মনিরুজ্জামান খান, সিনিয়র উপ-মহাব্যবস্থাপক (পাহাড়তলী সার্ভিসিং সেল) আনিসুর রব চৌধুরী’র সহায়তায় এ টাকা আত্মসাৎ করেন সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ করিম।
এই ৩ কর্মকর্তার সহায়তায় এমএ করিম কথিত ভবন মালিক মোহাম্মাদ আবছার আলমের নামে ২০১০ সালের ১৯ জুলাই জমি বিক্রি বাবদ কোম্পানির ৬১৩ নং ভাউচারের মাধ্যমে ৫০ লাখ ১৩ হাজার ৬৫০ টাকা এবং ভবনটির কথিত আরেক মালিক ফরহাদ আলমের নামে ৬১৪ নং ভাউচারের মাধ্যমে ২ কোটি ৪১ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫০ টাকা আত্মসাৎ করে। বাকি ৪১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ৬১৫ এবং ৬১৬ ভাউচারের মাধ্যমে কোম্পানি থেকে আত্মসাৎ করা হয়।
এমএ করিম ২০১০ সালের ১৮ জুলাই ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে ভবনের ফ্লোর স্পেস সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন না করেই কোম্পানির বোর্ড সভায় অনুমোদন করিয়ে নেয়। অথচ ভবনটির তৃতীয় তলা ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর আরএফ প্রপার্টিজ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি ও রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হয়।
প্রগ্রেসিভ লাইফের দুর্নীতির বিষয়ে বজলুর রশিদ বলেন, মুলত দুর্নীতির বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই অবৈধভাবে তারা কোম্পানি দখল করতে চেয়েছিল। আর এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্তদের মদদ ছিল। আইডিআেএর চেয়ারম্যান এম এ করিমকে বাঁচাতেই কোম্পানির অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এখন আদালত তাদের নির্দেশ দিয়েছে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে।
এক প্রশ্নের জবাবে দুর্নীতি দমন কমিশনে টাকা আত্মসাৎকারিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে এ বিষয়ে এম এ করিমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তারিখ-২১-১২-২০১৪