একটি বিক্রিত পলিসির সেবা

কল্যাণ চক্রবর্তী:

একটি জীবন বীমা পলিসি বিক্রয় করার পরই বীমা কর্মীর দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তাকে ভবিষ্যতে একজন সফল বীমা কর্মী হতে হলে পলিসি গ্রাহকদের বিক্রয় উত্তর সেবা প্রদান করতে হবে। একে After Sales Service বা Post sales Service বলা হয়। এ সেবা প্রদানের পরই একটি পলিসি ভবিষ্যতে চলবে, না তামাদি (Lapse) হবে তা নির্ভর করবে। সেবা প্রদান করলেও একটি পলিসি তামাদি হতে পারে। পলিসি গ্রাহকের চাহিদার সহিত সামঞ্জস্যহীন একটি পলিসি দিলেই তা তামাদি হবে। যেমন একজন ব্যক্তির ৫ লক্ষ টাকা পলিসির প্রয়োজন তাকে যদি ১ লক্ষ টাকার পলিসি প্রদান করা হয় আবার যার ১ লক্ষ টাকার পলিসির প্রয়োজন তাকে ৫ লক্ষ টাকার পলিসি দিলে সে কখনো চালাবে না বা চালাতে পারে না। তাই Over Sales বা Under Sales কখন করা উচিত নয়। এছাড়া কারো কুপরামর্শে, প্রিমিয়াম পদ্ধতি ত্রৈমাসিক হলে, কোম্পানির কাছ থেকে প্রিমিয়াম নোটিশ না পাওয়ার অজুহাতেও অনেক পলিসি গ্রাহক পলিসি চালাতে চান না। তাই জীবন বীমা ব্যবসা একটি পলিসি তামাদী হওয়া অনেকটা ক্যান্সার রোগের মত। এর কুফল আস্তে আস্তে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই একটি পলিসি গুণাগুণ বুঝে ক্রেতার সংগতির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ পলিসি দিতে হবে এবং বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান করে পলিসিটি সচল রাখতে হবে। জীবন বীমা পলিসির বিক্রয়োত্তর সেবার ভিতর যে সকল বিষয়গুলি লক্ষণীয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলঃ-

১) বয়স প্রমাণ (Admission of Age): একটি জীবন বীমা পলিসির বয়স প্রমাণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বীমা কর্মীরা বয়সের প্রমাণ ছাড়া পলিসি এফপিআর করানোর জন্য ব্যস্ত থাকেন। আর ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে কোন খোঁজ খবর রাখে না। মনে রাখা দরকার পলিসির বয়স প্রমাণ না করালে কোন দাবী মেটানো হয় না। তাই পলিসির বয়স প্রমাণ না করা থাকলে পরবর্তীতে পলিসি গ্রাহকের সহিত যোগাযোগ করে তার বীমার বয়স প্রমাণটি করে দিতে হবে। এতে ঐ বীমা গ্রহীতা যেমন ভবিষ্যতে ঝামেলামুক্ত হবে তেমনি তার সহিত যোগাযোগের ফলে নতুন ক্রেতার সন্ধান পাওয়া যাবে।

২) নমিনি নিয়োগ ও পরিবর্তন (Registration and change in nomination): অনেক সময় নমিনি ছাড়া পলিসি ইস্যু করা হয়। এই সকল ক্ষেত্রে পরবর্তীতে বীমা গ্রহীতার সহিত যোগাযোগ করে নমিনি নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। নমিনি না থাকলে বীমার মৃত্যু দাবী পরিশোধ করতে প্রচুর ঝামেলা হয়। তেমনি নমিনি পরিবর্তন চাইলে তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

৩) বীমা অঙ্ক ও মেয়াদ পরিবর্তন (Change the sum assured and term): অনেক বীমা গ্রাহক পলিসির মেয়াদের ভিতর বীমা অঙ্ক বা মেয়াদ পরিবর্তন করতে চান। এখানে কর্মীদের মনে রাখতে হবে, যে পরিবর্তন কোম্পানি বা বীমা গ্রহিতাকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে সে ধরণের কোন পরিবর্তন কোম্পানি অনুমোদন করবে না। প্রধানত পলিসিতে সমর্পন মূল্য অর্জনের পর এই জাতীয় পরিবর্তন করা যাবে না। তাই দু’ বৎসর পূর্বে এরকম পরিবর্তন গ্রহণ করা যাবে। ফলে দুই বৎসর চলার পর বীমা গ্রহীতাকে এই ধরনের পরিবর্তন মনোভাব প্রত্যাহার করার জন্য বুঝাতে হবে। তা না হলে বীমা গ্রহীতার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।

৪) প্রিমিয়াম প্রদান পদ্ধতি পরিবর্তন (Change in mode of Payment): প্রিমিয়াম প্রদান পদ্ধতি বার্ষিক, ষান্মাসিক ও ত্রৈমাসিক হয়। তবে বীমা কর্মীকে কোন ক্রমেই ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পলিসি বিক্রি করা উচিত নয়। যদি কোন কারণে ত্রৈমাসিক বা ষান্মাসিক কিস্তিতে পলিসি বিক্রি করা হয়ে থাকে তবে পরবর্তীতে বীমা গ্রহীতাকে বুঝিয়ে বার্ষিক কিস্তিতে পরিবর্তন করে দেয়া উচিত। আবার কোন কোন সময় বীমা গ্রাহক নিজেই বার বার প্রিমিয়াম দেয়ার চেয়ে বৎসরে এক কিস্তিতে প্রিমিয়াম দিতে চাইবে। ফলে তার সহিত যোগাযোগ রেখে এগুলি ঠিক করে দিতে হবে।

৫) তামাদী পলিসির পুনর্জীবন (Revival of lapsed Policy): বীমা কর্মী যদি সব সময় বীমা গ্রহীতার সহিত যোগাযোগ রাখেন তবে একটি পলিসি তামাদি হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে জীবন বীমা পলিসির তামাদি সংখ্যা অগণিত। এটা বীমা কোম্পানি, বীমা গ্রহীতা ও বীমা কর্মী কারো কাম্য নয়। তাই বীমা গ্রহীতাকে বুঝিয়ে তামাদি পলিসিকে পুনর্জীবিত করা প্রয়োজন। এত বীমা গ্রাহীতা যেমন উপকৃত হবে তেমনি উপকৃত হবে বীমা কর্মী ও বীমা কোম্পানি।

৬) কিস্তি দাবী (Survival Benefit): বর্তমানে আধুনিক সঞ্চয়ী বীমাগুলিতে মেয়াদের মধ্যে বীমাকৃত অঙ্কের একটি নির্দিষ্ট অংশ ফেরত দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বীমা চুক্তি করা হয়। মেয়াদের মধ্যে শর্তানুযায়ী একাধিক সময়ে যে আংশিক অর্থ প্রদান করা হয়, তাকে কিস্তি দাবী বলে। এগুলো সময়মত বীমা কর্মীকে কোম্পানির সহিত ও বীমা গ্রাহীতাদের সহিত যোগাযোগ করে এ টাকাগুলি বীমা গ্রহীতাকে পরিশোধ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এমনিতে বদনাম আছে বীমা করলে টাকা পাওয়া যায় না। ফলে এই দাবীটি যদি সময়মত পরিশোধ করা যায় তবে কিছুটা হলেও বীমার বদনাম ঘুচবে।

৭) ঠিকানা পরিবর্তন (Change of Address): বীমা একটি দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি। দীর্ঘ দিন ধরে বীমা গ্রাহকের ঠিকানা এক নাও থাকতে পারে। মেয়াদের মধ্যে বীমা গ্রাহকের ঠিকানা বদল করা হয়েছে অথচ বীমা কোম্পানি জানে না। এতে করে যোগাযোগের অভাবে অনেক পলিসি তামাদি হয়ে যায়। তাই মেয়াদের মধ্যে বীমা গ্রহীতার যোগাযোগের ঠিকানা যদি বদল হয়, তবে সাথে সাথে বীমা কোম্পনিকে অবহিত করে নথিভুক্ত করে ঠিকানা পলিসিতে লিপিবদ্ধ রাখতে হবে। যাতে পরবর্তীতে নতুন ঠিকানায় যোগাযোগ করা যায়।

৮) লোন (Loan): একটি জীবন বীমা পলিসি দুই বৎসর চলার পর সমর্পন মূল্য অর্জন করে এবং সমর্পন মূল্যের ৯০% লোন দেয়া হয়। যত বেশিদিন পলিসি চলবে ততো বেশি লোন পাওয়া যাবে। বীমা কর্মীকে বীমা গ্রহীতার সহিত যোগাযোগ করতে হবে। তার ব্যক্তিগত খোঁজ খবর নিতে হবে। দেখবেন সে একদিন বলতে পারে আমার খুব পয়সার দরকার মেয়ের বিয়ে কি করা যায় বলুন তো ভাই? সাথে সাথে বীমা কর্মীকে তার কাছ থেকে একটি লোনের আবেদন নিয়ে তার বীমা অনুকূলে লোন ইস্যু করে এককালীন কিছু টাকা দিতে পারলে সে মহা খুশি হবে। এর ফলে তার সুসময়ে আরো বীমা পলিসি গ্রহণ করতে পারে বা নতুন গ্রাহক সংগ্রহ বীমা প্রতিনিধিকে মন থেকে সাহায্য করবে।

৯) সমর্পন (Surrender): বীমা গ্রহীতার এমন অবস্থা হতে পারে যে সে তার পলিসিকে আর কোন দিন চালাতে পারবে না। এক্ষেত্রে তার বীমার সমর্পনমূল্য যা হবে তা ফেরত দেয়ার সমস্ত ব্যবস্থা বীমা কর্মীকে করে দিতে হবে।

১০) পলিসি পেইড আপ (Policy Paid up): বীমা গ্রাহক যদি প্রিমিয়াম দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন তাহলে সমর্পন না করিয়ে পলিসি পেইড আপ করে দেয়ার যুক্তি রাখা উচিত। এর ফলে জীবনের ঝুঁকি ও লাভ সহ মেয়াদে শেষ হলে সব টাকা ফেরত পাওয়া যায়।

১১) দাবী পরিশোধ (Settlement of claim): বীমার দাবী পরিশোধের ক্ষেত্রে বীমা কর্মীদের সব সময় বীমা গ্রহীতাকে সহযোগিতা করা উচিত। মৃত্যু দাবী, মেয়াদপূর্তি দাবী ইত্যাদি পরিশোধ করা বীমা কর্মীর একটি সফল্যতা বলা যায়। কেননা এতে করে বীমার বাজার সৃষ্টি হয়। ফলে বীমা গ্রহীতা যেন দাবী আদায়ের ঝামেলায় না পড়ে সেই জন্য সমস্ত পরামর্শ দিতে হবে। শুধু পরামর্শ নয় বীমা কোম্পানির সহিত যোগাযোগ করে তার দাবী যেন তাড়াতাড়ি পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। অফিসকে যত শীঘ্র কাগজপত্র দিয়ে সহযোগিতা করা যাবে দাবীও তত তাড়াতাড়ি পরিশোধ করা যাবে।

১২) স্বত্ব নিয়োগ (Assignment): বীমা গ্রাহক যদি তার পলিসি কোথাও স্বত্ব নিয়োগ করতে চান তাহলে বীমা কর্মীকে বীমা কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে সহিত যোগাযোগ করে তা করে দিতে হবে। আবার কখনো যদি শর্ত সাপেক্ষে স্বত্ব নিয়োগ প্রত্যাহার করা হয় তবে পুনরায় উক্ত পলিসিতে নমিনেশন করে দিতে হবে।

অতএব, একটি পলিসি বিক্রির পর উপরোক্ত সেবাগুলি প্রদান করে বীমা গ্রহীতার সাথে বীমা প্রতিনিধিকে একটি পারিবারিক যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে। মনে রাখবেন পলিসি গ্রাহকরাই হলো বড় Prospect। এদের দ্বারা বীমা কর্মীরা বেশি উপকৃত হবে। ফলে বিক্রয়োত্তর সেবা প্রদান একটি বীমা কর্মীর একান্ত আবশ্যকীয় কর্তব্য।

লেখক: সানলাইফ ইন্স্যুরেন্সে কোম্পানি লিমিটেড’র এডিশনাল ম্যানেজিং ডাইরেক্টর অ্যান্ড সিএফও।