বাংলাদেশের ক্ষুদ্রবীমার সার্বিক চিত্র তুলে ধরতে বিশেষ আয়োজন করেছে দেশের প্রথম এবং একমাত্র বীমা ভিত্তিক অনলাইন পোর্টাল ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি। বিশেষ আয়োজনের এ পর্বে ক্ষুদ্রবীমার ওপর অভিমত দিয়েছেন প্রোগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) দিপেন কুমার সাহা রয়। ইন্স্যুরেন্স নিউজ বিডি’র পাঠকদের জন্য অভিমতটি তুলে ধরা হলো:
প্রোগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা দিপেন কুমার সাহা বলেন, আমাদের দেশে ক্ষুদ্রবীমার প্রচলন করে ডেল্টা লাইফ। দেশের স্বল্প আয়ের মানুষদের বীমা সুবিধার আওতায় আনার জন্যই ক্ষুদ্রবীমার প্রচলন করা হয়। মূল ধারণাটি ছিল ক্ষুদ্রবীমার মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষদের সঞ্চয়ের একটি পথ করে দেয়া। নির্দিষ্ট একটি মেয়াদ পর্যন্ত খুব অল্প টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে যাতে স্বল্প আয়ের গ্রাহকটি মোটা অংকের একটি টাকা হাতে পায়। যা সে কাজে লাগাতে পারে। নানান প্রতিবন্ধকতার কারণে ক্ষুদ্রবীমাই এখন বীমা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির অন্যতম উপাদ্য হয়ে উঠেছে।
আমরা যাকে ক্ষুদ্রবীমা বলছি তা ক্ষুদ্রবীমা বলা হলেও এর গ্রাহক কিন্তু ক্ষুদ্র নয়। মুলত বীমা অংকটি ক্ষুদ্র। একটি পলিসি ক্রয়ে একক বীমার গ্রাহককে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয় ক্ষুদ্রবীমার একটি পলিসি করতে গ্রামের অশিক্ষিত স্বল্প আয়ের মানুষটিকে সেসব শর্ত পূরণ করতে হয়। পার্থক্য শুধু এই যে ক্ষুদ্রবীমায় বীমা অংক কম হওয়ার প্রিমিয়াম কম।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ক্ষুদ্রবীমার সংজ্ঞা কি হবে বা হওয়া উচিত। শুধু বীমা অংকের কম বেশির উপর ভিত্তি করেই কি ক্ষুদ্রবীমা সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যায়। যদি বলা হয় গ্রাহকের আয়ের উপর ভিত্তি করে একটি স্ল্যাব করে দেয়া যেতে পারে। যেমন যে ব্যক্তির বার্ষিক আয় ৫০ হাজার টাকা সে ক্ষুদ্রবীমার পলিসি কিনতে পারবে, অন্যরা তা কিনতে পারবে না। এভাবে বিচার করলে গ্রাহকের নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হবে কী না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এর কারণ একটি কোম্পানির কাছে সকল গ্রাহকই সমান। আমি কম প্রিমিয়াম দেই বলেই আমি ক্ষুদ্রবীমার গ্রাহক কথাটি ভালো শোনায় না।
আরেকটি বিষয় এখন যেসব পলিসি করা হচ্ছে সেখানে কতটা আইন মানা হচ্ছে। আইনে বলা হচ্ছে গ্রাহকের স্বাস্থ্যগত অবস্থা পারিবারিক ইতিহাস, আর্থিক সামর্থ্য বীমাযোগ্য স্বার্থের অন্যান্য দিক বিবেচনা করেই পলিসি করতে হবে। বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, তা করা হচ্ছে না। ফলে পলিসি তামাদি হয়ে যাচ্ছে, দাবি পরিশোধ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া ক্ষুদ্রবীমায় ঋণের যে সুবিধা রাখা হয়েছে তা বন্ধ করা উচিত। কারণ, পলিসি তামাদি হওয়ার ক্ষেত্রে এটারও ভূমিকা রয়েছে।
দিপেন কুমার সাহা আরো বলেন, ক্ষুদ্রবীমা বলে আমরা যেসব লোকদের বীমা করছি তারা লেখাপড়া জানে না। ফলে পলিসির শর্তে কি লেখা আছে তা সে জানে না। গ্রাহক তার শারীরিক অবস্থা, আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন নয়। গ্রাহক নিজেও জানে না সে কোনো রোগে ভুগছে কী না। এই গ্রাহকরা বীমার একজন মাঠকর্মীর বা এজেন্টের কথার উপর বিশ্বাস করেই বীমা করে। একজন মাঠকর্মী গ্রাহকের কাছ থেকে পাস বইয়ে স্বাক্ষর নিয়ে টাকা নিয়ে আসছে। টাকা জমা নেয়ার রশিদও হয়তো গ্রাহক অনেক সময় পায় না।
এখন যে মাঠকর্মী গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিল সে যদি কোম্পানিতে টাকা জমা না করে তাহলে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে ওই গ্রাহকই যখন কোম্পানিতে এসে টাকা দাবি করে তখন সেটা কোম্পানির জন্যও ক্ষতি। এখন এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায় একটাই সচেতনতা। গ্রাহকদের আরো সচেতন করতে হবে। আর সচেতনতা বাড়াতে সরকার বা এ খাতের সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থারই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব। অন্যদিকে কোম্পানিগুলোতে মাঠ পর্যায়ে বিশ্বস্ত কর্মী তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ থেকে শুরু করে প্রযুক্তির ব্যবহারসহ সবকিছুই করা যেতে পারে।
আরেকটি বিষয় সরকার ২০১২ সালে গ্রামীণ ও সামাজিক খাতে বীমাকারি দায়বদ্ধতা প্রবিধান পাস করেছে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি সরকার নিজেই নিম্ন আয়ের মানুষদের আর্থিক সেবা দিতে বীমার পৃথক প্রকল্প চালু করতে পারে। এই পরিকল্পে সরকারকেই টার্গেট পিপল ঠিক করে দিতে হবে। অর্থাৎ কারা এই বীমা আওতায় আসবে বা বীমা সুবিধা পাবে তা ঠিক করে দিতে হবে। সরকার এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে পারে। তবে এর বাস্তবায়ন করবে বীমা কোম্পানিগুলো।
উদাহরণ হিসাবে বলা হয়, ১০০ টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে নিম্ন আয়ের একজনকে সারা বছরের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া। অর্থাৎ ওই গ্রাহক ১০০ টাকা প্রিমিয়াম দেয়ার পর সারা বছরের চিকিৎসা সেবা বা খরচ বীমা কোম্পানির কাছ থেকে পাবে। বীমা কোম্পানিকে এ ধরণের সেবা দিতে ১০০ টাকার চেয়ে বেশি প্রিমিয়াম নিতে হয় তাহলে বাকি টাকা সে সরকারের কাছ থেকে পাবে। সে টাকা আর গ্রাহককে দিতে হবে না। তবে এ ধরনের প্রকল্পকে ক্ষুদ্রবীমা হিসেবে আখ্যায়িত করা হবে কি না তা ভেবে দেখা দরকার।
আমি বীমার লোক নই। আমি বীমা সম্পর্কে খুব ভালো জানিও না। তবে বীমা খাতে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে আমি ক্ষুদ্রবীমার যে চিত্র দেখেছি তাই বলা হলো। দেশে বা বিদেশে ক্ষুদ্রবীমার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ বা সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে অংশ নেয়ার সুযোগও আমার হয়নি।