আইন ভঙ্গ করে প্রশিক্ষণের সার্কুলার : বীমাখাতে দক্ষ জনবল তৈরির উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা
বীমা এজেন্টদের জন্য ৭২ ঘন্টার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে সার্কুলার জারি করেছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। আইন না মেনে সার্কুলারটি জারি করায় বীমা খাতের উন্নয়নে দক্ষ জনবল তৈরি করতে সরকারের পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সার্কুলারে বলা হয়েছে, বীমা এজেন্টদের লাইসেন্স পেতে আইডিআরএ স্বীকৃত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান থেকে ৭২ ঘন্টার বাস্তব প্রশিক্ষণ নিতে হবে। ১ জানুয়ারি ২০১৫ থেকে এ নির্দেশ কার্যকর হবে। ৭২ ঘন্টার এ প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে প্রত্যেক কোম্পানির মূখ্য নির্বাহিকে। বীমা আইন -২০১০ এর ১২৪ ধারার ৪ উপধারা এবং জাতীয় বীমা নীতি -২০১৪ এর ১.৪.২ এর বরাতে এ সার্কুলারটি জারি করেছে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষের সদস্য মো: কুদ্দুস খান স্বাক্ষরিত এ সার্কুলাটি জারি হয় ৭ ডিসেম্বর।
তবে এ সার্কুলারটি সংশ্লিষ্ট আইন মেনে করা হয়নি বলে জানিয়েছে বীমা সংশ্লিষ্টরা। বীমা বিশেজ্ঞরা মনে করছেন, বীমা আইন ২০১০ এর ১২৪ ধারার ৪ উপধারা অনুসারে বীমা এজেন্টদের যোগ্যতা নির্ধারণ করতে আইডিআরএকে প্রবিধান প্রণয়ন করতে হবে।অথচ আইডিআরএ প্রবিধান পাশ হওয়ার আগেই ৭২ ঘন্টার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করেছে প্রজ্ঞাপন দিয়ে। ফলে এ সার্কুলারটি আইনি ভিত্তি হারিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন নিয়ে আইনি জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এতে বীমা নীতি ২০১৪ এর অভিপ্রায় ও বীমা খাতে দক্ষ জনবল তৈরি নিয়ে সরকারের সকল পরিকল্পনাই হুমকির মূখে পড়তে পারে বলে আশংকা সংশ্লিষ্টদের।
জাতীয় বীমা নীতি - ২০১৪ এর ১ এর ৪ এর ২ এ বলা হয়েছে, স্বল্প শিক্ষিত বীমা কর্মী যারা মাঠ পর্যায়ে বীমা পণ্য বিক্রয়কাজে জড়িত, তাদের প্রশিক্ষণ না থাকায় গ্রাহককে বীমা সম্পর্কে আলোকিত না করে প্রলুদ্ধ করে। বীমা এজেন্ট নিয়োগের আইনগত শর্ত হচ্ছে, লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য কমপক্ষে ৭২ ঘন্টার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে পরীক্ষা দিয়ে পাস করার পর লাইসেন্স প্রদান। কিন্তু এটি প্রতিপালিত হচ্ছে না। ফলে অদক্ষ ও অযোগ্য বিক্রয়কর্মীর দ্বারা মানুষ অনেক ক্ষেত্রে প্রতারিত হচ্ছে।
বীমা আইন- ২০১০এর ১২৪ ধারার ৪ উপধারায় বলা হয়েছে, ’কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত প্রবিধান প্রণয়নের দ্বারা বীমা এজেন্ট নিয়োগের জন্য যোগ্যতা এবং অন্যান্য শর্তাবলী, বীমা এজেন্টদের নিবন্ধনের মেয়াদকাল, নবায়ন ফি, এবং অনুরুপ ফি পরিশোধের পদ্ধতি নির্ধারণ করিতে পারিবে।’
অন্যদিকে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ আইনে ’কর্তৃক্ষের কার্যাবলী ও দায়িত্ব’ সংক্রান্ত ১৫ ধারার ’চ’ উপধারায় বলা হয়েছে, ’মধ্যস্তাতাকারি, বীমা ও পূন:বীমা মধ্যস্তাতাকারি এবং এজেন্টদের আচরণ বিধি ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নিয়মাবলী ও নির্দেশিকা প্রণয়ন,’
সংশ্লিষ্ট আইনের ব্যাখ্যা করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বীমা আইন ২০১০ এর এ ধারা অনুসারে কর্তৃপক্ষ এজেন্ট নিয়োগের যোগ্যতা ও অন্যান্য শর্তাবলী সংক্রান্ত প্রবিধান প্রণয়ন করবে। এবং কর্তৃপক্ষ আইনের এ ধারা মতে কর্তৃপক্ষ এজেন্টদের আচরণবিধি ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নিয়মাবলী ও নির্দেশিকা প্রণয়ন করবে। এরপর তা বাস্তবায়নের জন্য সার্কুলার জারি করতে পারে। তার আগে নয়। আগে সার্কুলার জারি কোনোক্রমেই আইনসিদ্ধ নয়।
অন্যদিকে আইডিআরএ ওয়েব সাইটে দেয়া ননলাইফ বীমা এজেন্টদের লাইসেন্স প্রদান সংক্রান্ত খসড়া প্রবিধানের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, ননলাইফ বীমা ব্যবসার এজেন্ট হিসেবে আবেদনের জন্য আবেদনকারীকে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমী অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ননলাইফ বীমা ব্যবসা সংক্রান্ত নিয়োগপূর্ব পরীক্ষায় পাস করতে হবে।
৭ ধারায় বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে আবেদনকারীকে ননলাইফ বীমা ব্যবসায় ৭৫ ঘন্টার বাস্তব প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এটি নিতে হবে যারা প্রথম বারের মতো লাইসেন্সের জন্য আবেদন করবে।
একই নির্দেশ দেয়া আছে জীবন বীমা এজেন্টদের লাইসেন্স প্রদান সংক্রান্ত খসড়া প্রবিধানের ৫ ও ৬ ধারায়। এ দুটি ধারায় বলা হয়েছে, জীবন বীমা এজেন্ট হিসেবে লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীকে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমী অথবা কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়োগপূর্ব পরীক্ষায় পাস করতে হবে। একই সঙ্গে আবেদনকারীকে জীবন বীমা ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে ৭৫ ঘন্টার বাস্তব প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
বীমা আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, কোনো প্রবিধান না করেই সার্কুলার জারির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের হটকারিতা বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বা আইন না জানা কিংবা আইন না মানার মানসিকতার বহি:প্রকাশ। আইন ছেলে খেলার বিষয় নয়। আইন পরিপালন করতে হয় দাড়ি, কমাসহ। না হলে তা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাদের আরো অভিমত, নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ হয়তো সরকারের ভালো একটি উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করার জন্যই এ সার্কুলার জারি করেছে।
এছাড়া বীমা বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, দ্বীর্ঘদিন থেকে বীমা খাতে প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্ব পালন করে আসছে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমী (বিআইএ)। এজেন্টদের লাইসেন্স প্রদান সংক্রান্ত দু’টি খসড়া প্রবিধানেই বিআইএ থেকে প্রশিক্ষণের কথা বলা আছে। অথচ ৭২ ঘন্টার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করে জারি করা সার্কুলারে বিআইএ’র নাম নেই।
প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সার্কুলারটিতে বিআইএ’র নাম না দেয়ার পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব প্রাপ্তদের বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, তা সরকারের উচ্চ মহলের খতিয়ে দেখারও দাবি জানান তারা।
অভিযোগ উঠেছে, কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম. শেফাক আহমেদের আশির্বাদপুষ্ট একটি গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ ব্যবসা হাতিয়ে নেয়ার সুবিধা দিতেই প্রবিধান করার আগেই সাকুর্লারটি জারি করা হয়েছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ৭২ ঘন্টার প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত সার্কুলারটি জারি হরা হয় গত ৭ ডিসেম্বর।
তার দুই তিন দিন আগে থেকেই নবগঠিত একটি প্রশিক্ষন প্রতিষ্ঠানের লিফটলেট বিলি করা হয় যাতে প্রতিষ্ঠানটি আইডিআরএ স্বীকৃত দাবি করা হয়েছে।
তারিখ-১৬-১২-২০১৪