দাবি অযোগ্য পলিসিতে স্ট্যান্ডার্ডের বীমা দাবি: ১০ কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের গুজব

দ্বিতীয় কিস্তি: স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের বীমা দাবি আদায়ে যেসব পলিসি দেখানো হয়েছে এসব পলিসি করতে কোনো আইনই মানা হয়নি। সবগুলো পলিসি করা হয়েছে প্রিমিয়াম বাকিতে, প্রি-ইন্সপেকশন ছাড়া। রি-ইন্সুরেন্স করা হয়েছে বাকি রেখে, কোনো কোনো পলিসিতে রি-ইন্স্যুরেন্সও করা হয়নি।পরিচালকদের মালিকানাধীন অন্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সংগ্রহের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের জারি করা ২৬ ও ২৬ বি নম্বর সার্কুলার মানা হয়নি। আইনত দাবি অযোগ্য এমন সব পলিসিতেই ২ শ’ কোটির টাকার উপরে দাবি তুলেছে স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স। এদিকে, দাবি আদায়ে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ম্যানেজ করতে প্রায় ১০ কোটি টাকা লেনদেন করেছে স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ, এমন গুজব রয়েছে বীমা বাজারে। সম্প্রতি সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিবর্তন হওয়ায় নতুন করে ম্যানেজ তৎপরতা চালাচ্ছে এ গ্রুপটি বলেও গুজব উঠেছে। উল্লেখ্য, পূন:বীমার আইন অনুসারে বেসরকারি বীমা কোম্পানিকে বাধ্যতামূলকভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা কর্পোরেশনে রি-ইন্স্যুরেন্স করতে হয়। স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের উত্থাপিত এ বীমা দাবি পরিশোধ করতে হবে সাধারণ বীমা কর্পোরেশন থেকেই। স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের বীমা দাবিতে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গঠন করা আইডিআরএ’র তদন্ত দলের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় বিভিন্ন পলিসি এবং এনডোর্সমেন্ট এ মারাত্মক অসঙ্গতি উঠে এসেছে। স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এ্যামেক্স লিমিটেডের নামে অগ্নিবীমার একটি পলিসির বীমা অংক ৪০ কোটি টাকা। পলিসি নম্বর-এসআইএল/ইআরবি/ এফপি- ০২২/০২/২০১৩। এ পলিসি ইস্যু করা হয়েছে ১৮ ফ্রেবুয়ারি ২০১৩। পলিসির প্রিমিয়াম জমা করা হয়েছে ২০ ফেব্রুয়ারি। আর ব্যাংকে তা জমা করা হয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ পলিসিটি করা হয়েছে বাকিতে। এই পলিসিটি ইস্যুর আগে কোনো পূর্ব জরীপ করা হয় নাই। পলিসিটি ইস্যু করা হয়েছে ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ । অথচ এই পলিসির পূর্ব জরীপ প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে পলিসি করার ৮ মাস পরে। অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর ২০১৩। এই পলিসির আওতায় এনডোর্সমেন্ট করা হয়েছে ২টি। একটি এনডোর্সমেন্ট (এনডোর্সমেন্ট নম্বর-০০৪/০৩/২০১৩) দেখানো হয়েছে পলিসি ইস্যু করার এক মাস পরে। এতে বীমা অংক বাড়ানো হয়েছে ১৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এই এনডোর্সমেন্টটি ইস্যু করা হয়েছে ১৪ মার্চ ২০১৩। এনডোর্সমেন্টটির প্রিমিয়ামের টাকার চেক ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে ১৮ মার্চ ২০১৩। ব্যাংক তা হিসাব ভুক্ত করেছে ১৯ মার্চ ২০১৩। অর্থাৎ এটিও করা হয়েছে বাকিতে। অপর একটি এনডোর্সমেন্ট দেখানো হয়েছে (০০২২-১০-২০১৩) আগুন লাগার ২৭ দিন আগে। এনডোর্সমেন্ট ইস্যু করা হয়েছে ৩১ অক্টোবর ২০১৩। অবস্থা পরিবর্তন (সিচুয়েশন চেঞ্জ) দেখিয়ে এই এনডোর্সমেন্ট করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মূল পলিসি করা ছিল কারখানা ভবনের পূব পাশের ৪র্থ ফ্লোর তথা ৫ তলার। সিচুয়েশন চেঞ্জের মাধ্যমে বীমা পলিসিটির ঝুঁকি ফ্লোর ৮ম এ তথা ৯ তলায় দেখানো হয়েছে। অথচ ৮ ফ্লোর বা ৯ তলা এর আগে কোনো পলিসির আওতায় ছিল না। পলিসিটিতে ঝুঁকি নেয়া ৫ তলায় আগুনে কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয় নাই। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৯ তলায়। আগুনে ক্ষতি হয়েছে এমন তলাতেই পলিসিটি স্থানান্তর দেখানো হয়। একই সঙ্গে কত টাকার মালামাল ৮ম ফ্লোর এ স্থানান্তর করা হলো তা ও এনডোর্সমেন্ট এ উল্লেখ নাই। এ কারণে আগুন লাগার পর এনডোর্সমেন্টটি করা হয়েছে বলে বীমা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। এ্যামেক্স ইন্টারন্যাশনালের এ পলিসির রি-ইন্স্যুরেন্স করার ক্ষেত্রেও আইন মানা হয় নাই। অনসন্ধানে দেখা গেছে, পলিসিটির মোট বীমা অংক ৪০ কোটি। এর মধ্যে ওয়ন রিটেনশন ৫০ লাখ। সারপ্লাস ট্রিটি ২৫ কোটি। সারপ্লাস ট্রিটি ও ওয়ন রিটেনশন মিলে মোট দাড়ায় ২৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ফ্যাকালটেটিভ রি-ইন্স্যুরেন্স দেখানো হয়েছে ১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অথচ ফ্যাকালটেটিভ রি-ইন্স্যুরেন্সের বিপরীতে কোনো রি-ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম সাধারণ বীমা করপোরেশনকে পরিশোধ করা হয় নাই। আইন অনুসারে ফ্যাকালটেটিভ রি-ইন্স্যুরেন্স প্রিমিয়াম রি-ইন্স্যুরেন্স করার ১৫ দিনের মধ্যে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনকে পরিশোধ করা আবশ্যক। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট পলিসির অধীনে কোনো দাবি উত্থাপিত হলে তা পরিশোধ যোগ্য নয়। এ পলিসির বিষয়ে বীমা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পলিসিটি করার ক্ষেত্রে কোনো আইন না মানায় পলিসিটি দাবি পাওয়ার যোগ্য নয়। জানা গেছে, বাকি ব্যবসা করার দায়ে বিভিন্ন বীমা কোম্পানিকে লাখ লাখ টাকা জরিমানাসহ শাখা অফিস বন্ধ করে দিচ্ছে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। গ্রাহকদের দাবি আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করতেই আইডিআরএ বাকি ব্যবসা বন্ধে উদ্যোগ নেয়। অথচ স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সে স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের করা সবগুলো পলিসিই করা হয়েছে বাকিতে। স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের পলিসি করার ক্ষেত্রে বাকি করার বিষয়ে বীমা সংশ্লিষ্টরা বলেন, পরিচালকদের ব্যবসা বলেই বাকি করার পর এসব পলিসির বিপরীতে স্ট্যান্ডার্ড ইন্সুরেন্স দাবি আদায়ে চেষ্টা করছে। গ্রাহক অন্য কেউ হলে প্রিমিয়াম বাকি রাখার অজুহাতে দাবিগুলো তারা নিজেরাই নাকচ করে দিত। তাদের সবগুলো পলিসিতে বাকি করার বিষয়টি অস্বাভাবিক। পলিসির কাগজপত্র কারখানাতে আগুন লাগার পরও করা হতে পারে। রাতারাতি পলিসির কাগজপত্র তৈরী করা হয়েছে বলেই তাদেরকে সবগুলো পলিসিতে বাকি দেখাতে হয়েছে। কেননা আইন অনুযায়ী ব্যাংক ড্রাফ্ট বা একাউন্ট পেয়ি চেকের মাধ্যমে প্রিমিয়ামের টাকা পরিশোধ হওয়ার পরই পলিসির কাগজপত্র গ্রাহকের নিকট হস্তান্তর করতে হয়। আইন অনুসারে যে কোন পলিসি খোলার আগে প্রি-ইন্সপেকশন বাধ্যতামূলক। অথচ স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের কোনো পলিসিরই প্রি-ইন্সপেকশন করা হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলিসি করার আগেই প্রি-ইন্সপেকশন করার নিয়ম। প্রি-ইন্সপেকশনে জরীপকারীকে ফি বাবদ প্রতিটি পলিসিতে দিতে হয় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। এ কারণে অনেক কোম্পানি প্রি-ইন্সপেকশন করতে চায় না। অথচ সঠিকভাবে অবলিখন করার জন্য প্রি-ইন্সপেকশন বাধ্যতামূলক। কোম্পানিগুলো আরও একটি কারণে প্রি-ইন্সপেকশন করে না। প্রি-ইন্সপেকশন করা হলে বীমা ঝুঁকির সকল দায় - দায়িত্ব বীমা কোম্পানির ওপর বর্তায়। ফলে কোম্পানিগুলো কোনোভাবেই ফাঁকি দেয়ার সুযোগ পায় না। আবার দাবির ক্ষয়ক্ষতির পরিমান বাড়িয়ে দেখানোর সুযোগ থাকে না। আইন অনুসারে বীমা কোম্পানি পরিচালকদের মালিকানাধীন অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে করা পলিসির বিপরীতে দাবি উত্থাপিত হলে তা ২ কর্মদিবসের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। অথচ এ পলিসির দাবি উত্থাপনে তা করা হয়নি। অপরদিকে পরিচালকদের ব্যবসা সংক্রান্ত তথ্য পলিসি ইস্যু করার পরবর্তী মাসের ১০ দিনের মধ্যে আইডিআরকে জানাতে হয়। অথচ এই পলিসির আওতায় ০০৪/০৩/ ২০১৩ এনডোর্সমেন্টটি ইস্যু করা হয় ১৪ মার্চ ২০১৩ আর তা জানানো হয় ১১ এপ্রিল। অপর এনডোর্সমেন্টের (০২২/১০/২০১৩) কোনো তথ্যই নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষক ও সাধারণ বীমা করপোরেশনকে জানানো হয়নি। একই অবস্থা অন্যান্য পলিসির ক্ষেত্রেও। বীমাখাত সংশ্লিষ্টদের অভিমত, ৪৫০ কোটি টাকার দাবি নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর আইডিআরএর উচিত ছিল বীমা খাতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোকদের নিয়ে কমিটি গঠন করা। এতে তদন্ত আরো সুষ্ঠু হতো। আরো অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র পাওয়া যেত। তবে সাধারণ বীমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টার গুজব অস্বীকার করেছেন গ্রুপের বীমা কোম্পানি স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অমর কৃষ্ণ সাহা। ইন্স্যুরেন্স নিউজবিডির সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, আমরা ২০০ কোটি টাকার কিছু বেশি দাবি উত্থাপন করেছি। এখন সাধারণ বীমা কর্পোরেশন থেকে কোনো আপত্তি না করলে আমরা পুরো দাবি পাবো বলে আশা করছি। কতটাকার বীমা দাবি পাবো তা নির্ভর করছে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ওপর। উল্লেখ্য, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোট ২৮টি পলিসি ইস্যু করা হয়। এর মধ্যে অগ্নি বীমায় ১৬টি পলিসি ও নৌবীমায় ১২টি পলিসি ইস্যু করে ওই গ্রুপেরই মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড ইন্স্যুরেন্স। গত বছর ২৮ নভেম্বর আগুনে পুড়ে যায় স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের বহুতল ভবন। এতে ক্ষতি হয় ১ হাজার ২০২ কোটি টাকা। তারিখ: ৩০ নভেম্বর, ২০১৪