কোটি টাকার অবৈধ সুবিধা নিয়েছেন ন্যাশনাল লাইফের পরিচালকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক: আইন অমান্য করে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালকরা। অবৈধ এ আর্থিক সুবিধা তারা নিয়েছেন পারিতোষিক, কোম্পানির গাড়ির ব্যবহার, বিমান ভাড়া ও ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত লেনদেনের মাধ্যমে। সম্প্রতি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) বিশেষ এক নিরিক্ষায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

সূত্র মতে, বীমা আইন ২০১০ এর ৭৮ ধারা অনুসারে পরিচালকরা বোর্ড ফি ছাড়া অন্যকোনোভাবে আথির্ক সুবিধা নিতে পারেন না। অথচ ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম এমপি, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল মোনেম ও একজন স্বতন্ত্র পরিচালক ৩ বছরে পারিতোষিক নিয়েছেন ৬১ লাখ ২৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে কোম্পানির চেয়ারম্যান নিয়েছেন ৩৯ লাখ ৯৫ হাজার ৯৬৮ টাকা, ভাইস চেয়ারম্যান নিয়েছেন ১৬ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮৪ টাকা, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়েছেন ৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

এছাড়া বোর্ড সভায় অনুপস্থিত থেকেও যাতায়াত খরচ বাবদ বিমান ভাড়া বাবাদ ১ লাখ টাকা নিয়েছেন সদস্যরা। বোর্ড সভায় আমন্ত্রিত অতিথিদেরকেও ফি দেয়া হয়েছে ৫ হাজার টাকা করে। ২০১৪ সালে এ খাতে ব্যয় করা হয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

অপর বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, কোস্পানির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান এসআই চৌধুরী বিমান ভাড়া আগেই নিয়ে নিতেন। আর চট্টগ্রাম থেকে বাসে বা ট্রেনে তিনি ঢাকায় আসতেন বলে অভিযোগ রযেছে। এর আগে পরিচালক থাকা অবস্থাতেও তিনি চট্টগ্রাম সার্ভিসিং সেলের কনসালটেন্ট হিসেবে ১৯৯২ সালে নিয়োগ পান। এ সময় তার বেতন ছিল ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। পরে পরিচালকদের চাকরি করার উপর আইডিআরএ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তাকে এ পদ ছেড়ে দিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্ত এতে তিনি রাজি হননি। পরে কোম্পানির পক্ষ থেকে একটি গাড়ি উপহার দেয়ার পর তিনি ২০১৩ সালে কনসালটেন্ট পদ ছেড়ে দেন।

আইডিআরএ’র নিরীক্ষায় দেখা যায়, পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, হাবিব জামান, হাবিবুর রহমান ও সফিকুর রহমান টিটু অবৈধভাবে ২টি গাড়ি ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রো চ-৫৩-২৩৫৮ নং গাড়িটি ব্যবহার করেছেন ৪ হাজার ২৬ কিলোমিটার ও ঢাকা মেট্রো চ- ৫৩২৫৭০ নং গাড়িটি ব্যবহার করেছেন ১৯২৫ কিলোমিটার। অবৈধভাবে গাড়ি ব্যবহার করার বিষয়ে এসব পরিচালকদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।

এছাড়া আইডিআরএর সার্কুলার অনুসারে কোম্পানির পরিবহন পুলে ৪টি গাড়ি রাখার নির্দেশ দেয়া হলে পুলে গাড়ি রয়েছে ১৪৭টি। এসব গাড়ি রাখা হয়েছে জোন অফিসে ব্যবহারের জন্য। এছাড়া আরো ৭টি মাইক্রোবাস রাখা হয়েছে প্রধান কার্যালয়ে ব্যবহারের জন্য।

আইডিআরএ’র নিরীক্ষায় আরো উল্লেখ করা হয়, কোম্পানির চেয়ারম্যানের ব্যবহারের জন্য গাড়ির মূল্য নির্ধারণ করা আছে ৮৫ লাখ টাকা। অথচ কোম্পানির চেয়ারম্যানের জন্য গাড়ি কেনা হয়েছে ১ কোটি ৪১ লাখ ৮৫ হাজার টাকায়। চেয়ারম্যানের গাড়ির জন্য অবৈধভাবে ব্যয় করা হয়েছে ৫৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

অপর একটি সূত্র জানায়, এর আগে চেয়ারম্যানের ব্যবহারের জন্য কেনা একটি পাজেরো গাড়ি কোম্পানির কাছ থেকে নাম মাত্র মূল্যে কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান কিনে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি প্রথমে মাইক্রোবাস ব্যবহার করতাম। পরে পাজেরো ব্যবহার করেছি। কিন্তু পাজেরো গাড়িটি নাম মাত্র মূল্যে বর্তমান চেয়ারম্যান কিনে নিয়েছেন এমন তথ্য আমার জানা নেই।

অন্যদিকে প্রকিউরমেন্ট রুলস অমান্য করে নাম মাত্র দামে কোম্পানির গাড়ি কিনেছেন ২ পরিচালক ও এক পরিচালকের মনোনিতক। এরা হলেন সফিউল আজম চৌধুরী, ইমরুল আলম ও তার মনোনিতক নাজনীন সারোয়ার। গাড়িগুলো হলো- ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৬৫৬, ঢাকা মেট্রো-গ-১৪-৬০২২ ও ঢাকা মেট্রো-গ-১৩-৪৪১৩।

আইডিআরএর ওই নিরীক্ষায় আরো দেখা যায়, বর্তমান চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম এমপি’র প্রতিষ্ঠান আরটিভিতে ২ বছরে বিজ্ঞাপন প্রচারের বিল বাবদ ১ কোটি ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও ২০১৪ সালে ৮০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ টাকা পরিশোধের তথ্য গোপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ একাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুসারে এ ধরণের লেনদেন শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে প্রকাশ করার বিধান রয়েছে।

এসব বিষয়ে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পরিচালক বলেন, পরিচালকরা নানাভাবে সুবিধা নিয়ে আসছেন। এটা সব প্রতিষ্ঠানেই। এখন আইডিআরএ যদি বলে এ ধরণের সুবিধা নেয়া যাবে না তাহলে আমরা নিবনা। তিনি আরো বলেন, আইডিআরএ নিরীক্ষা করেছে। নিরীক্ষা অনুসারে আইডিআরএ যে নির্দেশ দেবে আমরা তা মেনে নিব। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই সংশোধনের সুযোগ দেয়া উচিত।