কমিশন নিয়ে ন্যাশনাল লাইফের কোটি টাকার দুর্নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বীমা আইন লঙ্ঘন করে লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের কোটি কোটি টাকা কমিশন দিয়েছে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স। পাশাপাশি কমিশন ব্যয় দেখিয়ে বীমা গ্রাহকদের মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে প্রতিষ্ঠানটি একই ব্যক্তিকে একাধিক পদের জন্য কমিশন দিয়েছে।

এমনকি এজেন্ট নয় এমন ব্যক্তির নামেও কমিশন দেয়া হয়েছে। আর এসব কমিশন দেয়া হয়েছে নগদ অর্থে। এক্ষেত্রেও বীমা আইনের কোন তোয়াক্কা করেনি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই জীবন বীমা কোম্পানি। বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) এক বিশেষ নিরীক্ষা চালিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের কমিশন দেয়ার বিষয়ে যে তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টাঙ্গাইল ও দেবীদ্বার জোনাল অফিসে গড়ে ৯৯ শতাংশ কমিশনই দেয়া হয়েছে লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের। এই অফিস দু’টি মডেল এরিয়া অফিস হিসেবে বিবেচিত।

ন্যাশনাল লাইফের মোট জোনাল অফিস আছে ২১০টি। এরমধ্যে মডেল এরিয়া অফিস ১৩টি। প্রতিষ্ঠানটির মোট প্রিমিয়ামের ১৪ শতাংশই আসে এই মডেল এরিয়া অফিসের মাধ্যমে। বাকি ১৯৭টি জোনাল অফিসের মাধ্যমে প্রিমিয়াম আসে ৬৮ শতাংশ।

টাঙ্গাইল ও দেবীদ্বার জোনাল অফিসের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল এই তিন বছরে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা কমিশন দেয়া হয়েছে লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের। এরমধ্যে টাঙ্গাইল অফিস থেকে ২০১২ সালে ৯৪ লাখ ৩৮ হাজার ৫০৫ টাকা, ২০১৩ সালে ৯২ লাখ ২৯ হাজার ৮৩৫ টাকা এবং ২০১৪ সালে ৯০ লাখ ৬১ হাজার ৩০৯ টাকা অবৈধভাবে কমিশন দেয়া হয়েছে।

আর দেবীদ্বার অফিসের মাধ্যমে ২০১২ সালে ৯১ লাখ ৩৮ হাজার ৬৪৮ টাকা, ২০১৩ সালে ৯৩ লাখ ২২ হাজার ৮৯৯ টাকা এবং ২০১৪ সালে ৭৩ লাখ ৬১ হাজার ৪১০ টাকা অবৈধভাবে কমিশন হিসেবে লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বীমা আইন ২০১০ এর ২(২৯) এবং ১২৪(১) ধারা লঙ্ঘন করেছে।

নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতেও প্রতিষ্ঠানটি লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের কমিশন দিয়েছে। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল এই তিন বছরে টাঙ্গাইল, দেবীদ্বার ও নাঙ্গলকোট তিনটি জোনাল অফিসের মাধ্যমে এভাবে কমিশন দেয়া হয়েছে ৫ কোটি ৫৮ লাখ ৬১ হাজার ৯১৪ টাকা।

লাইসেন্স বিহীন এজেন্টদের কমিশন দেয়ার পাশাপাশি কোম্পানিটি এ দু’টি শাখায় ২০১৪ সালে ডামি এজেন্টদের অর্থাৎ পরিচয় বিহীনদের নামে অবৈধভাবে কমিশন ব্যয় দেখিয়েছে ৪ লাখ ২ হাজার ৯৬৬ টাকা। যা বীমা আইন ২০১০ এর ২(২৯) ধারা এবং ১২৪ ধারার লঙ্ঘন। একই সঙ্গে বীমা আইনের এ দু’টি ধারা লঙ্ঘন করে দেবিদ্বার অফিসে ফতেমা বেগম নামের একজন বহিরাগতকে একাধিক বীমা পলিসির বিপরীতে কমিশন দেয়া হয়েছে।

এদিকে একই ব্যক্তিকে একাধিক পদে দেখিয়ে কমিশন দেয়ার মতোও অনিয়ম করেছে ন্যাশনাল লাইফ। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি এজেন্ট অথবা এমপ্লয়ার অব এজেন্ট নামে কমিশন ব্যয় দেখিয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন কোড ব্যবহার করে ফার্মগেট, দেবীদ্বার, বি. বাড়ীয়া ও টঙ্গীতে ২৪ জনকে এমন কমিশন দেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ অনিয়মের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠানটি বীমা আইন ২০১০ এর ২(২৯) এবং ১২৪ ধারা লঙ্ঘন করেছে।

তথ্য পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, ন্যাশনাল লাইফ আইন লঙ্ঘন করে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩ বছরে নগদে কমিশন পরিশোধ করেছে ২৮৭ কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ কমিশন প্রিমিয়াম আয় থেকে সরাসরি সমন্বয় করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির সরকারকে বিপুল অঙ্কের আয়কর ফাঁকি দিয়েছে। অন্যদিকে এর মাধ্যমে মানিলন্ডারিং হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নগদে দেয়া কমিশনের মধ্যে প্রথম বর্ষ প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে ২৫৫ কোটি ৯৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। আর নবায়ন প্রিমিয়াম আয়ের বিপরীতে পরিশোধ করা হয়েছে ৩১ কোটি ৩৬ লাখ ৯১ হাজার টাকা।

একক প্রিমিয়াম পলিসিতে কমিশন দেয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম করেছে এই জীবন বীমা কোম্পানিটি। একক প্রিমিয়াম পলিসিতে অবৈধভাবে ১০ শতাংশ কমিশন দেয়া হয়েছে। অথচ ১৯৫৮ সালের ৩৯ ধারা অনুসারে একক প্রিমিয়াম পলিসি কমিশন হার ৫ শতাংশ।

২০১৩ ও ১৪ সালে একক প্রিমিয়াম পলিসিতে অবৈধ কমিশন দিয়েছে ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ২ কোটি ৮২ লাখ ৩৪ হাজার ৩০৩ টাকা এবং ২০১৪ সালে ২ কোটি ৮৫ লাখ ২২ হাজার ৪৮১ টাকা। অভিযোগ রয়েছে কোম্পানির পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিষদের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা এ টাকা আত্মসাৎ করেছে।

ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জামাল এ নাসেরের সঙ্গে বুধবার এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি এখনো প্রতিবেদনটি দেখিনি। তাই এ বিষয়ে স্টাডি না করে কোন কিছু বলতে পারছি না। আমি স্টাডি করার পর এ বিলয়ে জানাবো।

তবে আজ বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ তিনি বলেন, আপনার প্রশ্ন আমি পেয়েছি। এ বিষয়ে আমাদের গণসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাকে এ বিষয়ে বিস্তারি জানানো আছে। তিনিই আপনাকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন।

পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে কোম্পানির গণসংযোগ কর্মকর্তা জনির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এই নিরীক্ষার বিষয়ে আইডিআরএ কোন শুনানী না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।